গভীর রাতে যাতায়াত ছিল একটি কালো গাড়ির
সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টু, তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্যও আছেন। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নিজামপুর গ্রামে আবার রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের পানিশাইল(নিজগাঁও) এলাকায়ও তার একটি বাড়ী আছে। মন্টু বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন বলে জানা যায়। দেশের গ্রামীণ এলাকায় একজন উকীল আবার আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য সহ বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, এমন মানুষের প্রভাব নিয়ে কোন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্ততঃ লীগ শাসনের যে চেহারা দিন দিন আমাদের সামনে ভেসে উঠছে তাতে এমন একজন প্রভাবশালী মানুষের দাপট নিয়ে নতুন করে বানিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
এই রকিব মন্টুকে নিয়ে দেশের পাঠকখ্যাত একটি অনলাইন(ঢাকা পোষ্ট) যে সংবাদ প্রকাশ করেছে তা রীতিমত ভীতি সঞ্চারক। এই মন্টু একটি খুনের মামলা করেন তার মামা নুরুল ইসলাম(৮৩) ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। মামলাটি দায়ের করা হয়েছিলো গত ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর। কারণ ওই রাতেই ‘নিজগাঁও কমিউনিটি ক্লিনিকে’র পাশে আব্দুর রকিব মন্টুর সম্পত্তির দেখাশুনাকারী আব্দুল মালেককে কে বা কারা হত্যা করে ফেলে যায়। পরে ওই রাতেই পুলিশ গিয়ে নুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সব সদস্যদের ধরে নিয়ে আসে। এ ঘটনায় অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টু বাদী হয়ে রাজনগর থানায় ওই পরিবারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
রাতের আঁধারে কি ঘটতো “বশির-রাবেয়া কটেজ”-এ
মামলার কারণে নুরুল ইসলামের পরিবারের সবাই কারাগারে থাকার সুযোগে তার বসতঘরসহ সব জমি দখলে নেন মন্টু। পরে ‘বশির-রাবেয়া কটেজ’ নাম দিয়ে নুরুল ইসলামের বসতঘরসহ নিজের জমির সামনের দিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেন তিনি। ওই সীমানা প্রাচীরের ভেতরে নির্মাণ করা হয় একচালা টিনের আধাপাকা সাতটি আলাদা আলাদা ঘর। প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের রহস্যজনক এসব ঘরে নেই কোনো জানালা। রহস্যময় এ ঘরগুলোতে কি হতো এলাকার কেউ জানেনা।
“বশির-রাবেয়া কটেজ”। যুবলীগ নেতার দখলিজমিতে গড়া বাগানবাড়ী। টিনেরচালার ৭টি পাকাঘর। ছবির ভেতরে ডানে যুবলীগ নেতার ছবি। ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। |
নিজগাঁও এলাকার বাসিন্দারা জানান, দিনের বেলায় কখনও এসব ঘর খুলতে দেখেননি তারা। তবে গভীর রাতে আব্দুর রকিব মন্টু লোকজন নিয়ে কালো রঙের একটি গাড়িতে করে এখানে আসতেন। আবার ভোররাতের দিকে বেরিয়ে যেতেন। তাকে স্থানীয়রা এতোটাই ভয় পেতেন যে প্রাচীরের ভেতরে যাওয়ার সাহস কেউ কোনদিন করেননি।
এলাকায় খুঁজ নিতে গেলে পানিশাইল গ্রামের একজন নান্নু মিয়া সংবাদদাতাকে বলেন যে তারা ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছেন মন্টুর মামা নুরুল ইসলাম এ বাড়িতে বসবাস করছেন। তারা আরও বলেছেন যে তাদের এলাকায় একটি হত্যা ঘটনায় নুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা জেলে থাকার সময় মন্টু মিয়া তার বাড়ি ও জমিজমা দখল করে নেন এবং সেখানে জানালাবিহীন ৭টি ছোট ঘর নির্মাণ করেন তিনি। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় এসব ঘরে মন্টু ও তার লোকজন আসতেন। রাতে ঘরে কি করতেন আস-পাশের মানুষ তা জানে না। তারা মনে করেন এসব ঘরের দরজা খুলে দেখা দরকার ওরা ওখানে কি করতো।
এদিকে, প্রায় আড়াই বছর পর চলতি বছরের জুন মাসে হত্যা মামলা থেকে জামিনে বের হয়ে নুরুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা অবাক বিস্ময়ে দেখেন বসতঘরসহ প্রায় ৪০ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে মন্টু। তাদের রেখে যাওয়া বড় বড় গাছগুলো কেটে নেয়া হয়েছে। নুরুল ইসলামের জমিতে গড়ে তুলেছেন গাছের বাগান ও ঘর। এছাড়া মন্টুর সীমানা প্রাচীরের ভেতরে তার জমিও ঢুকিয়ে নিয়েছেন।
ওই গ্রামের মানিক মিয়া নামের অপর একজন বলেন, এখানে নিজের ঘরে থেকে নুরুল ইসলাম তার মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তাদের ঘরে নাতি-নাতনি হয়েছে। তার জমির দলিল ও কাগজপত্র আছে। তবুও তাদের সে ঘরেই থাকতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। নুরুল ইসলাম যদি হত্যা করে থাকেনও, তাতে তার জমি ও বসতঘর মন্টুর হয়ে যেতে পারে না।
নুরুল ইসলাম কলা মিয়া বলেন, আমি ৭০ বছর এই বাড়িতে থাকছি। আমার বোন ও বোনের ছেলেরা আমাকে স্থায়ীভাবে থাকতে এসব জমি আমার কাছে বিক্রি করেছেন বলে লিখে দিয়েছেন। সব কাগজপত্র আমার থাকার পরও এই জমি কেড়ে নিতে বারবার মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে মন্টু। তার মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে প্রায় আড়াই বছর জেল খেটেছি। আমার বিবাহযোগ্য কলেজে পড়ুয়া মেয়েও মামলা থেকে বাদ যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নাতিটাকেও ছাড়েনি। এখন জামিনে এসে নিজের ভিটায় প্রবেশ করতে পারছি না। এখনো পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
জেলে থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে
জানালাবিহীন খুপড়ীমত গোদাম ঘর। রাতের আঁধারে কি হতো এসব ঘরে? ছবি সংগৃহীত। |
নুরুল ইসলাম কলা মিয়ার নাতি আজিজুর রহমান প্রান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুঃখ ভরা কন্ঠে বলেন যে, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। মন্টুর করা মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকায় অনুপস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় তার ছাত্রত্ব বাতিল করেছে। এইচএসসি পড়ুয়া তার ছোট খালাকেও জেলে নেওয়া হয়েছে। বিদেশে থাকা তার এক মামাকেও আসামি করা হয়েছে। পুরো পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এই মন্টু। ৮৩ বছর বয়সের তার বৃদ্ধ নানা অসহায়ের মতো অন্যত্র ভাড়া থাকছেন ৩ মাস ধরে। গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় তার নানা বাড়িতে উঠেছেন। কিন্তু পুলিশ নানাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করছে।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যমটি লিখেছে যে তারা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আব্দুর রকিব মন্টুকে একাধিকবার ফোন করেও কাউকে তারা পায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই তার আর কোনো খোঁজ নেই।
বিষয়টি নিয়ে রাজনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) শাহ মো. মুবাশ্বির ওই সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে ওই বৃদ্ধের পরিবারকে ঘরে থাকতে বাঁধা দেওয়া হবে না। জমি নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে আদালতে দুটি মামলা চলমান আছে। বৃদ্ধের ঘরে প্রবেশ করা নিয়ে একজন অভিযোগ করেছিলেন। আমরা বলে দিয়েছি, এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না।