কোন ভূমিকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এমন কঠিণ নির্মম সত্যকে ভূমিকা টেনে অযথাই লম্বা করা হবে। তাই কোন ভূমিকায় না গিয়ে সাংবাদিক মোস্তাফিজদের সৃষ্টিগাঁথা হুবহু তুলে ধরলাম।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, একজন অসৎ সাংবাদিকের আত্মকাহিনীর খানিকটা শুনবেন? প্লিজ শুনুন…
# যমুনা টিভিতে ছিলাম ডেপুটি এডিটর হয়ে। টেস্ট ট্রান্সমিশনে থাকা অবস্থায় বন্ধ করে দেয়া হলো প্রতিষ্ঠানটি। আমরা চার শতাধিক সংবাদকর্মী তখন প্রতিষ্ঠানটিতে। যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বাবুলকে অনেকেই গালাগাল করেন, তার সমালোচনা করেন। কিন্তু তিনি বন্ধ প্রতিষ্ঠানটিতেও মাসের পর মাস সোয়া কোটি টাকা প্রতিমাসে শুধু বেতনই দিয়ে গেছেন। কাজ ছাড়া বেতন নেয়াটা অনৈতিক মনে হলো। তাই ছেড়ে দিলাম যমুনা টিভি।
তখন থাকি বনশ্রীতে। একাই থাকতাম ১৪৫০ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। বিল-টিলসহ খরচ প্রায় ১৪ হাজার টাকা। চাকরি ছাড়ায় মাসের শেষে বেতনটা বন্ধ হয়ে গেল। ২/৩ মাস পর বাসা ভাড়া দেয়াটাও কষ্টকর হয়ে উঠলো। এক পর্যায়ে পকেটে খাবারের টাকাও থাকে না। এলো রোজার মাস। প্রতিদিন বনশ্রী সি ব্লক থেকে হেঁটে প্রেসক্লাব অথবা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)-তে যাই। তখন আবার আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)-র নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক। একদিন ইউনিয়ন অফিসে গেলে পরদিন যাই ডিআরইউ-তে। যাই বিনা খরচে ইফতারি খেতে। সারাদিনে পেটে যেত শুধু ওই ইফতারিটুকুই। ২৪ ঘন্টা পর আবার ইফতারি। যেদিন বনশ্রী থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত হেঁটে আসার শক্তি থাকতো না সেদিন ওয়াসার পানিই সম্বল। পরদিন হয়তো দুপুর ২টায় বাসা থেকে বের হতাম। পথে পথে বিশ্রাম নিতে নিতে যেতাম ইফতারি খেতে।
ডিইউজে-র যুগ্ম সম্পাদকের চাঁদাবাজি বা তদ্বিরবাজির যোগ্যতা না থাকায় খাবারের অভাবে ২৪ ঘন্টায় একবার বিনা পয়সায় খাওয়ার জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতাম।
২.
আবার, সেসময়ের আরেকটি কথা বলতে পারি। ঈদের দু’দিন আগে গণমাধ্যমে আমার অভিভাবক, বড়ো ভাই শাহ আলমগীর ভাই ফোন করে তাঁর সাথে দেখা করতে বললেন। তিনি তখন মাছরাঙা টিভি’র বার্তা প্রধান। আমি মাছরাঙায় গেলাম। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আলমগীর ভাই একটি খাম দিলেন আমাকে। বললেন, ৫ হাজার টাকা আছে এতে। তোমার ঈদি। আলমগীর ভাই এমনই। আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। সেই স্কুল জীবন থেকে আলমগীর ভাইকে চিনি। তাঁর ছায়া বঞ্চিত হইনি কোন দিন। তাই আমার চরম আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যে আলমগীর ভাই ঈদ বোনাস হাতে পেয়েই আমাকে ফোন করেছিলেন। আলমগীর ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আলমগীর ভাই, আপনি টাকাটা দিয়েছেন… আমার ভাল লেগেছে। আমি যদি এখন আর্থিক অস্বচ্ছ্বলতার মধ্যে না থাকতাম তাহলে আনন্দের সাথে নিতে পারতাম। কিন্তু এখন আপনি দিচ্ছেন ভালবেসে, কিন্তু আমার মনে হবে এটা দয়া। তাই প্লিজ, টাকাটা আমাকে দিয়েন না। বরং একটা চাকরি দেন।
৩.
আবার আমার ছেলে জন্মাবার সময় আমি বেকার ছিলাম। তার সাড়ে ৪ মাস বয়সে চাকরি পেলাম। ততোদিন তার জন্য দুধ কেনার সামর্থও আমার ছিল না। ৪২ দিনের মাথায় ইন্টারনাল পলিটিক্সে চাকরি হারালাম। ৪২ দিনের বেতন পকেটে নিয়ে আবার অনিশ্চিত জীবনের পথে নামলাম। বাসায় ফেরার পথে চাকরি হারাবার কথা ভুলে গেলাম। শান্তিনগর বাজারে গিয়ে এক পাউণ্ডের এক কৌটা দুধ কিনলাম। বাজার থেকে বাসায় আসার পুরো পথটা কাঁদতে কাঁদতে এলাম। পথে মানুষ জিজ্ঞেস করেন, কোন প্রিয়জন মারা গেছেন কিনা। তাদের বলি, আজ আমি নিজের টাকায় ছেলের জন্য প্রথম দুধ কিনলাম, সে আনন্দে কাঁদছি।
৪.
এখন বাঙলা টিভির মালিক। একসময় তার একটি নিউজ এজেন্সি ছিল। ১৯৯৬ সালের মার্চে সে এজেন্সিতে রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। প্রথম তিন মাস পার হলো। বেতন পাচ্ছি না। প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে যিনি ছিলেন (এখন প্রথম সারির একটি দৈনিকের সিনিয়র রিপোর্টার) আমাকে জানালেন সম্পাদক আমাকে বেতন দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ, সেখানে চাকরি পেয়েই আমি ধন্য হয়েছি। অথচ তার আগে আমি সেসময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা আজকের কাগজের বুধবারের কাগজ প্রাত্যহিকে শাহরিয়ার রেজা ভাইয়ের সহকারি হিসেবে কাজ করছিলাম। নিউজ এজেন্সি থেকে আমি আমার পাওনা অধিকার আদায় করেছিলাম। মালিক বাধ্য হয়েছিলেন প্রতিমাসে আমার সাড়ে তিন হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে।
.
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, এমন অসংখ্য ঘটনার কথা বলতে পারি আমি ও আমার হাজারো সহকর্মী। আমরা নৈতিকতা বিসর্জন দেই না। আমরা কাজ করে পারিশ্রমিক নেই। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনের বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে লড়াই করেছি। প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের ধামাধরাদের বিরুদ্ধে আবার লড়বো।
জাতির জনক লড়াই করে অধিকার আদায় করতে আমাদের শিখিয়ে গেছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করেছে। এ শোকের মাসে তাঁর শিখিয়ে যাওয়া লড়াইয়ের পথ ধরেই প্রয়োজনে আমরা আমাদের সম্মান-মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে নামবো।