রাসপূর্ণিমা উৎসব বাংলাদেশের মনিপুরী আদিবাসী তথা বৃহত্তর সিলেটের মণিপুরী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করা হয়। রাস উৎসব উপলক্ষে আয়োজন করা হয় রাসনৃত্যের। রাসনৃত্য মনিপুরী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্রুপদী ধারার এক অপূর্ব শৈল্পিক সৃষ্টি।
কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতিথিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলার আয়োজন করা হয়। আগামী শুক্রবার ১৫ নভেম্বর মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী ‘রাস উৎসব’। কমলগঞ্জের মণিপুরি মহারাসলীলায় রাতভর শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা পরিবেশনের মাধ্যমে দর্শকদের বিমোহিত করে রাখবে শিল্পীরা। সূর্যের উঁকিতে আকাশে যখন আলো ছড়িয়ে পড়ে, তখনই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটবে।
এবারও মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে মাধবপুর জোড়ামন্ডপ এবং আদমপুর মন্ডপে ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা নানা মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। শত বছরের পুরোনো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের শিববাজারে জোড়ামণ্ডপে ১৮১ বছর এবং আদমপুরের তেতইগাঁওয়ে প্রায় ৪১ বছর ধরে মণিপুরীদের রাস উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে।
জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্ন দেখে নৃত্যগীতে যে প্রার্থনার শুরু করেছিলেন, সেটাই রাস উৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশির ভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশ নিতেন। সেই ধারাবাহিকতায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে উদ্যাপিত হয়ে আসছে রাস উৎসব। বর্নাঢ্য আয়োজন, মৃদঙ্গ, করতাল ও শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলা ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন ঘিরে এই দিনটি সকলের উৎসব হয়ে ওঠে।
মণিপুরি নৃত্যকলা ভারতীয় উপমহাদেশের নৃত্যকলায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কমলগঞ্জের নৃত্যশিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা।
বাংলাদেশে রাস উৎসব অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে প্রথম এ দেশে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করে। বাংলা ১২৮৯ সন নাগাদ ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দের শারদীয় পূর্ণিমা তিথিতে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবং মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় রাসলীলা।
মহারাসলীলা আয়োজকদের পক্ষে, মনিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারন সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, আগামী ১৫ নভেম্বর, দামোদর মাসখ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাসপূর্ণিমা বা মহারাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। ১৮২ তম এই উৎসব প্রস্তুতির কাজ শেষ পর্যায়ে।
কমলগঞ্জ মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কমকর্তা প্রভাস চন্দ্র সিংহ বলেন, এবারের মহারাসলীলার ১৮২ তম উৎসব। মাধবপুরের এই মহারাস উৎসব একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে থাকে। কারণ এই উৎসবে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে উৎসবটি এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয়। প্রতিবছর এই মেলায় লক্ষাধিক ভক্তবৃন্দের সমাগম হয়ে থাকে। সাথে থাকে শত রকমের সামগ্রীতে ভরপুর দোকানপাট। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। প্রতিবছর কার্তিকীয় পূর্ণিমাতিথিতে এই মহোৎসব উৎযাপিত হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করেই রাসলীলা রচিত হয়েছে। দেশের এই প্রাচীনতম উৎসব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আয়োজনের জন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করে থাকেন।
মুলত এই রাস উৎসবে সারাদেশের আগ্রহী মানুষের ঢল নামে কমলগঞ্জে। ধর্ম বর্ণ জাতপাত নির্বিশেষে সকল মানুষের অংশগ্রহণে এটি পরিনত হয় এক মহামিলন মেলায়।