বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সামিয়া মিয়া একজন লেখক, সাংবাদিক ও আলোকচিত্রকর(ফটোগ্রাফার)। তাঁর আন্দোলন পদ্বতিগত নির্যাতন ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে। তিনি লিখেনও এই আলোকেই। ২০২১এর ২৯ এপ্রিল লিখেছেন লণ্ডনের কেমডেন জার্ণালে। তার লিখার বিষয় এদেশের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। বিশেষ করে কেমডেনের গৃহহীন শিশু-কিশোর-কিশোরীদের দুরাবস্তা নিয়ে। প্রাঞ্জল ও সবলীল তার লিখায় বস্তুনিষ্ঠতা দেদীপ্যমান থাকে। এ লিখায় তিনি নতুন করে তার একটি মতের সংযোজন করেছেন আর তা হলো বৃটেনের রাজতন্ত্রের বিপক্ষে; কথা বলেছেন প্রকাশ্যে। বলেছেন রাজতন্ত্রই অসমতা ও বর্ণবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। বাংগালী জনগোষ্ঠীর কাজে লাগতে পারে এমন চিন্তা থেকে আমরা তার এ লিখাকে অনুবাদ করে পত্রস্ত করলাম। – সম্পাদক
রাজকুমার উইলিয়াম যে সেবা সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক একজন বালিকা হিসেবে আমি সে সংগঠনের দান-বৃত্তি-সুবিধা ভোগী হতে পেরেছিলাম। গৃহহীন কিশোর-কিশোরী বিষয়ে সজাগ করে তোলার কাজ আমরা দু’জনে একত্রে মিলে করেছি। যদিও আমি এ যুক্তি/নিমিত্ত/হেতু’র উপর খুব আবেগাপ্লুত ছিলাম, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, যদি আমরা সত্যিকার অর্থে অসাম্য তুলতে চাই তা’হলে রাজতন্ত্রকে বাতিল হতে হবে। কারণ এই কিশোর-কিশোরী গৃহহীনতা বোঁটা দিয়ে জন্ম নেয় ও পরে ডালপালা-শাখাপ্রশাখা দিয়ে গঁজিয়ে উঠে ওই মূলগত অসাম্য ও বর্ণবাদের কারণ থেকে। কোন শিশু-কিশোরেরই গৃহহীন হওয়া উচিৎ নয় কিংবা গৃহহীন হতে পারে শুরুতেই এমন অবস্থায় পড়া সঠিক নয় অন্ততঃ বৃটেনের মত উন্নত বিশ্বের সুবিধা পাওয়া একটি দেশে।
আমরা কিভাবে কোন ধরণের ভাব-বিচার না করেই আমাদের রাজস্ব করের লক্ষ লক্ষ টাকা একটি পরিবারকে দিতে পারি? অথচ আমরা দুঃখ দারীদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী অবহেলিত শিশু-কিশোরদের দিনে ১টি পাউণ্ড দিতে গিয়ে কতই না বিচার-বিবেচনা করি। এটি অবশ্যই নীতিজ্ঞানহীনতা।
সম্প্রতি আমি “রাজতন্ত্র বাতিল কর” বলে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলাম; এর বিনিময়ে যে কিপরিমাণ বিকৃত গালিগালাজের সম্মুখীন হয়েছি কিছু মানুষের কাছ থেকে যারা আমাকে প্রচণ্ড উগ্র হিংসাত্বক অনেক মন্দ কথার পাশাপাশি বলেছে যে, ‘আমি বৃটিশ ছিলাম না’! এসব গালিগালাজকারীদের একজন কেমডেনে আমার স্কুলতীর্থদের একজন। জ্বলন্ত সত্য হলো, তাদের এমনসব প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে যে আমার কথাগুলো সত্য যে বর্ণবাদ বৃটেনে পাকাপোক্ত হয়ে আসন গেড়েছে এবং অবশ্যই সারা বিশ্বে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাণী যখন ‘কমনওয়েল্থ’ এর সবাইকে বললেন দেশকে পূণর্গঠনের জন্য; ওই সময় আমার বাবা ও তার ভাইয়েরা বাংলাদেশ ছাড়েন একটি সুন্দর জীবনের খোঁজে ও তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার নিমিত্ত। আমি নব্বইয়ের দশকে(১৯৯০) সমার্সটাউনে জন্ম নিয়েছি এবং বেড়ে উঠেছি। বৃটেনে কঠিণ শ্রমজীবন পাড় করে আমার বাবা মারা যান মাত্র ৪০ বছর বয়সে যখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৫বছর। এমন অবস্থায় আমার গরীব মা ও ভাইদের মানসিক অবস্থা বাবার অন্তর্ধানে রাতারাতি ভেঙ্গেপড়ে। ভেঙ্গেপড়া মানসিক অবস্থার আরো অবনতি হয় চরম দারীদ্র আর একাকীত্বের কারণে। সে অবস্থায়ই মা থেকে আমরা ছিটকে পড়ি বাঁচার তাগিদে।
ফলে, একটি খুবই ব্যস্ত কাজের পরিবার তাদের কর্মক্ষমতা হারায় এবং অকর্মন্য হয়ে পড়ে। যার ফল স্বরূপ পরিবারটির মানুষগুলো শারিরীক ও মানসিক উভয়ভাবেই অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয় বিশেষ করে আমি। আর এমন অবস্থার সূচনা হয় তখনই যখন আমি মাত্র ৬বছর বয়সের অবুঝ খুকি।
দারীদ্র সীমার নিচে বাস করায় এসময় আমি শিশু নিরাপত্তার তালিকায় ছিলাম। এ সময় আমার নাম কিশোরী সেবিকার তালিকায়ও উঠেছিল কারণ আমি আমার মায়ের পক্ষে চিঠি ও টেলিফোনের কথা অনুবাদ করে মা’কে বুঝাতাম। স্কুলের শেষে মা’কে নিয়ে কেমডেন মহাসড়কে অবস্থিত ডাকঘরে যেতাম তার সরকারী সাহায্যের ক্ষুদ্র অর্থ তুলে আনতে এবং মায়ের সকল ঘরোয়া খরচপাতি পরিশোধ করতে। সেবাকারী ও অনুবাদক হিসেবে কাউন্সিল, ব্যাঙ্ক কিংবা অন্যত্রও নির্ধারিত সময়ে যেতাম কারণ নিযুক্ত অনুবাদকদের প্রায়ই পাওয়া যেতো না। পায়ে হেটে আমি মায়ের সকল বাজার সওদা করে ব্যাগভর্তি জিনিষ নিয়ে ঘরে ফিরতাম। আমি এ কাজগুলো না করলে মা দুশ্চিন্তা ও অবস হয়ে রাস্তায়ই কবট লেগে পড়ে যেতেন।
৮ বছর বয়স থেকে আমি একাই স্কুলে যাওয়া শুরু করি। অপরিস্কার কাপড়-চোপড় আর এলোমেলো চুলে স্কুলে যেতাম। কখনও কোন বন্ধু আমার এ অবস্থার কথা জানতে চাইলে আমি বলতাম-‘আমি জানিনা।’ সস্তাদামের স্কুল কাপড়ের জন্য(স্কুল ইউনিফর্ম) আমাকে পরিহাসের শিকার হতে হতো এবং অনেক জ্বালাতন সহ্য করতে হতো। মাত্র এক প্রস্ত স্কুল কাপড়ের জন্য আমার ক্লাসের সাদা ছাত্রীরা আমাকে উপহাস করে হাসতো, সাদা ছাত্ররা প্রহসন করে(বাড-বাড-ডিং) আওয়াজ দিয়ে আমাকেসহ আমাদের মানুষজনকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ করতো এবং পরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। এসব ব্যঙ্গ উপহাসের বিষয়ে আমি কাউকেই কিছু বলতাম না। ভয়ে বলতাম না। আমি ভাবতাম এসকল কথা অভিযোগে নিলে আমার মা-বাবাকে পুলিশ ধরে জেলে দেবে যা আমার মা-বাবা কোনভাবেই সুরাহা করতে পারবে না। আমি স্কুলে আসলেই কোন সাহায্য পাইনি কারণ আমার শিক্ষার মান ছিল খুব ভাল যদিও আমার স্কুল উপস্থিতি ছিল খুবই খারাপ। ১৬ বছর বয়সে পৌঁছার আগ অবদি এসমূহ ব্যঙ্গ উপহাসকে আমি মেনে নিয়েছিলাম। ১৬ বছরে পৌঁছে বুঝতে পারলাম যে এখন আমি আমার আইনী অভিভাবক হতে পারবো।
১৬ বছর বয়সে আমার জিসিএসই চূড়ান্ত পরীক্ষার পর আমি ঘর ছেড়ে ডিল্যান্সি স্ট্রীটের গৃহহীন যুবক-যুবতী হোষ্টেলে গিয়ে উঠলাম। সেখানে যারা কাজ করেন তারা আমাকে বললেন যে আমি যেনো তাদের পক্ষ থেকে আমার এই যুবতী গৃহহীন বিষয়টিকে মানুষের মাঝে প্রচার করি। আমাকে সুযোগ করে দেয়া হলো এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি প্রিন্স উইলিয়ামের সাথে স্বেচ্ছাসেবায় কাজ শুরু করি। সে কাজ দীর্ঘ ১১বছর করেছি। রাজকুমারের সাথে থেকে বক্তৃতা করতে আমাকে বলা হতো। আমাদের কাজের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে বলা হতো এবং তার সাথে সংবাদমাধ্যমের জন্য ছবি তুলতে বলা হতো। যেহেতু আমি ছবি তুলতে জানতাম। আমার মনে হয় উইলিয়াম মানুষ হিসেবে ভালই। তিনি আমাকে তার সাথে ছবি তুলতে দিতেন কিংবা তার সাথে কোন সভায় কথা বলার জন্য আমাকে ডাকতেন। তাকে সবসময়ই আমার কাছে ভাল মনে হয়েছে এবং প্রতীয়মান হতো যে তিনি খুব সুন্দর মনের মানুষ। আমি ও আমার মত আরো যারা তাদের প্রতি উইলিয়ামের সহমর্মিতা খুবই খাঁটী। এতোসব খাঁটীর মধ্যে আরো একটি খাঁটী গুণ দেখেছি তা হয়তো অনেকেই জানেন আবার নাও জানতে পারেন। সেগুলো হলো- অসাম্য, পদ্বতিগত অবিচার এবং সাদা মানসিকতা।
আমিই সেরা বা আমরাই সেরা অন্য কথায় সর্বোচ্চতমতা বা মহত্তমতা এসব মানসিকতার জন্ম দিয়েছে উপনিবেশবাদ যা এদেশের সকল স্তরের গভীরে পৌঁছে আছে। আমাদের বহুমূল্যবান সাজানো রাস্তার উপর মরছে গৃহহীন মানুষজন, মর্মপীড়ায় বাকরুদ্ধ সেবাকর্মীরা অভুক্ত থাকছে আর শিশুরা দারীদ্রতার মধ্যদিয়ে মা-বাবার সেবাকর্মী হিসেবে বড় হচ্ছে; এগুলো খুবই সত্য। আমরা যখন রাজতন্ত্র রক্ষার জন্য কথা বলি মূলতঃ আমরা অতি প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গিকেই রক্ষা করার কথা বলি যে চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি মনে করে এ বিশ্বে কিছু কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায় মহত্তম হয়েই জন্মায়। আর এ প্রবণতাকেই বলে সাদাদের প্রভুত্ব। আর এই অন্ধ নেশাকারী বিশ্বাসের পক্ষে কথা বলার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক অসাম্যতা ও পদ্বতিগত বর্ণবাদের বর্বর হামলায় আমাদের জীবন দিতে হচ্ছে।
আপনারা অনেকেই হয়তো বলছেন আমার উপর যা হয়ে গেছে তা ছিল খুবই দুর্লভ একটি ঘটনা।
জ্বী না, এমন ঘটনাটি শুধু আমার নয় এমন চরম বর্ণবাদি জীবন সংহারি পৈশাচিক আচরণের শিকার হয়ে কিশোর সেবাকর্মী হিসেবে জীবন চালাচ্ছে এ দেশের ৮লাখ শিশু-কিশোর। এ জরিপ বিবিসি’র। ‘কিশোর গৃহহীন’দের তথ্যব্যাংক মতে ১লাখ ২১হাজার কিশোর এদেশে গৃহহীন কিংবা গৃহহীন হবে এমন চরম বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। কিশোর দারীদ্রতার উপর ২০২০সালের সরকারী তথ্য বিবরণী বলছে এদেশে বিগত ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চার বছর সময়ে ৬৭ভাগ বাংলাদেশী শিশু-কিশোর দারীদ্রতম জীবন যাপন করছে। মহামারীর এ সময়ে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
আমাদের মত শিশু-কিশোরেরা মনে করতেই পারে যে আমাদের জন্ম অন্য রূপের। কারণ, এ দেশ এবং রাষ্ট্রের দ্বারা এসব শিশু-কিশোরদের জন্মের পর থেকেই অসাম্যের ভেতর দিয়ে দেখা-শুনা করে আসছে।
আমরা ফাঁদে পতিত শিশু-কিশোর! এ বিশ্বে এসে প্রথম শ্বাস নেয়ার আগে থেকেই আমাদের জীবন শুরু হয়েছিল বিশাল বঞ্চনার ভেতর দিয়ে যা কোন নমুনায়ই মানবিকতা ছিল না।
দরীদ্রতার মাঝে যেসকল শিশু-কিশোর বাস করছে, ইদানিং আমরা, তাদেরকে অতি নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে সেই অসাম্যকেই উৎসাহিত করছি। কিন্তু কেনো?
কারণ আমরা চাই না দরীদ্র শিশু-কিশোরগন স্কুলে ভাল ফল করুক। দরীদ্র শিশু-কিশোররা স্কুলের পাঠে কোন সময়ই মনোযোগী হতে পারবে না। এ কারণে এরা পরবর্তী জীবনে সফল হতে পারবে না। ফলে এরা যে তিমিরে আছে সেখানেই থেকে যাবে। তাই, বৃটেনে অসাম্যতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং উদ্দেশ্যমূলক। প্রত্যেকেই অবচেতনভাবে মনের ভেতর থেকে প্রভাবিত এই ভাবধারায় যে সকল সমান নয়। প্রত্যেক ডাক্তার, শিক্ষক, বিচারক, সেবাকর্মী এবং আইন ব্যবসায়ী সকলেই আমরা, বিষফল এই প্রাতিষ্ঠানিক অসাম্য বর্ণবাদকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাইয়া রাখায় কাজ করে যাচ্ছি।
সোমার্স টাউন থেকে ‘সেকেণ্ডারী স্কুল’ এর পড়া শেষ করার পর আমার শিক্ষাবছরের প্রধান আমাকে বলেছিলেন যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক আমার মত কিশোরীদের(যারা বাঙ্গালি ও কিশোরী, হিযাব পড়ে ও নিরব থাকে) অবজ্ঞা করেন, করেন উপেক্ষা। কারণ তারা মনে করেন স্কুলের পড়া শেষ হবার সাথে সাথেই আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে অভিভাবকদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে।
আপনি যদি কোন শিক্ষক হন তা’হলে দরীদ্র শিশু-কিশোর-কিশোরীদের কোন ধরনের দারীদ্রতার চিহ্নকে অবজ্ঞা করবেন না এবং নিজের মতামতকে তাদের উপর চালিয়ে দেবেন না। আপনি যদি একজন জিপি হন এবং রোগী যখন তার নিজের রোগের কথা বলবে, দয়াকরে রোগীর কথায় বিশ্বাস রাখবেন কারণ একমাত্র সেই তার শরীর বিষয়ে ভাল বুঝে এবং সে মহিলা বা পুরুষ রোগীকে সাহায্য করবেন, সে যে বর্ণের বা সম্প্রদায়েরই লোক হোক না কেনো। আপনি যদি একজন চাকুরী দাতা হন তা’হলে অন্ধ ভাবে নিয়োগ করবেন না। আপনার ব্যবসাক্ষেত্রকে সকলের জন্য নিরাপদ রাখবেন।
আপনি যে ই হোন, নিজের ঘরে, স্কুলে কিংবা ব্যবসায় আলাপ-আলোচনা করবেন কিভাবে আমরা একে অন্যকে ইতিবাচকভাবে সাহায্য করতে পারি। কেবলমাত্র বছরের একবার নেতিবাচক প্রশিক্ষনই যথেষ্ট নয়। আমাদের সমতা ও সমদর্শিতা বা ন্যায়বিচারেরও প্রয়োজন।
মূল সামিয়া মিয়া। অনুবাদ হারুনূর রশীদ। কৃতজ্ঞতা কেমডেন নিউ জার্ণাল
|