আটলান্টায় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-(যদিও কিছুকাল যাবৎ যোগাযোগ নেই) আটলান্টার প্রাচীনতম কেন্দ্রীয় আল-ফারুক মসজিদের স্বেচ্ছাসেবক গোলাম দস্তগীর ভাই(কুড়িগ্রাম) ও আমি প্রতি রমজানে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতাম, এতেকাফও করতাম। একদা এতেকাফের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় কথাবার্তা বেশি হতে লাগলো। ফলে ইবাদত-বন্দেগীতে মন লাগানো যাচ্ছিলো না। কেউ না কেউ কথাবার্তায়, ফোনালাপে রত আছেন সারাক্ষণ। দস্তগীর ভাইকে চাপ দিলাম(তিনি আমীর) উনাদের যেনো আস্তে কথা বলতে বলেন। আস্তে কথা বলতে বলায় সবাই একদম চুপ হয়ে গেলেন! এখন তারা আর খাওয়ার সময়ও কথা বলেন না। স্বভাবতই আমরা এতেকাফে বিভিন্ন দেশের লোক, বাংলাদেশি আমরা মাত্র দুইজন। খাওয়ার সময় তিনি বললেন, আস্তে আস্তে কথা বলা যাবে। কথা বলা একেবারে বন্ধ করার দরকার নেই। একজন বললেন, কি যন্ত্রণা, একবার বলেন চুপ থাকতে, আবার বলেন কথা বলা যাবে।
দস্তগীর ভাই এক মজার গল্প শোনালেন! তাদের কুড়িগ্রামে নাকি একটা মাজার আছে ‘চুপ শাহর’ মাজার। চুপ শাহর আসল নাম কেউ জানে না। তিনি ছিলেন এক মস্ত বড় পীর বুজুর্গ ওয়ালি আউলিয়ার সাগরেদ। একদা পীরের সাথে দেখা করতে আসেন কিছু লোক। পীরের সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে দেখা গেলো চুপ শাহ বেশি বেশি কথা বলছেন! অনেক সময় পীরের কথার উপরও তিনি কথা বলছেন! ফলে তার গুরু তার উপর রেগে গিয়ে ভর্ৎসনা করে বলেন : ‘মেরা বিল্লি মেরা সামনে মিউ মিউ করতা হ্যাঁয়! চুপ রহ!’ ব্যাস, ওই এক কথায়ই তিনি একদম চুপ বনে যান। পীর যতদিন জিন্দা ছিলেন, তিনি আর কথা বলেননি। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো পীর মারা যাওয়ার পর। এখন আর কথা বলতে সমস্যা নেই, তাই তিনি কথা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন কথা না বলায় তিনি চেষ্টা করেও আর কথা বলতে পারলেন না। তার জবান চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবেই বোবা অবস্থায় একদিন তিনিও মৃত্যুমুখে পতিত হন। কুড়িগ্রামে কোথাও নাকি চুপ শাহ’র মাজার বিরাজমান।
বলছিলাম এককালের আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কথা। তিনি কিছুকাল যাবৎ চুপ হয়ে বসে আছেন। করোনাক্রান্তিতে দেশে মহামারি, তিনি চুপ। এই উপলক্ষে দেশে মহাচুরি, তিনি চুপ। দেশে একটি বাজেট ঘোষণা করা হলো, তিনি চুপ। এ বাজেট মানুষ মারার বাজেট, নাকি মানুষ বাঁচানোর বাজেট- চুপ থাকলে আমরা জানবো কি করে। এ অবস্থা চলতে থাকলেতো চুপ শাহ’র মাজারে দেশ ভরে যাবে!
এমন কি, স্বেচ্ছা নির্বাসিত উনার জ্যেষ্ঠ পুত্রও চুপ মেরে বসে আছেন। সংসদে সিট কম থাকলেও তার দল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।তার শর্ত স্বাপেক্ষ কারামুক্তিতে তার নিজ দলের কোন ভূমিকা নেই- এ কথা সবাই জানে। পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়রা সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাকে হয়তো একটা সমঝোতার মাধ্যমে বের করে এনেছেন। কিন্তু তাই বলে এভাবে চুপ থাকলেতো একদিন জবান বন্ধ হয়ে যাবে। চেষ্টা করলেও আর কথা বলতে পারবেন না। আর বললেও দেশের মানুষ গুরুত্ব দেবে না। মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের কথা। জেলে থেকে জেলের দেয়ালে নাকি লিখে ফেলেন- ‘এ দেশ ছাড়বি কিনা বল। নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল…’ আপনার ‘আপোষহীন নেত্রী’ খেতাব কি তাহলে বিফলে গেলো! এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে চুপ শাহ’র দরবারে দেশ ছেয়ে যাবে সন্দেহ নেই।
বর্তমান ক্রান্তিকালে মুখে খৈ ফোটানো অনেকেই ‘চুপ শাহ’ বনে গেছেন! সরকারের সমালোচনায় অতীতে সোচ্চার তিন মাহমুদ(মান্না মাহমুদ, আমার দেশ মাহমুদ ও শওকত মাহমুদ) এখন চুপ শাহ বনে গেছেন। চুপ মেরে আছেন এককালের তূখোড় সাংবাদিক শফিক রেহমান। চুপ করে আছেন টক-শো কাঁপানো ব্যারিস্টার মঈনূল হোসেন ও আন্দালিব রহমান পার্থ। মওদুদ তো দুনিয়া ছেড়েই চলে গেছেন। তারা বাজেট নিয়েও কোন কথা বলছেন না। আর জামাতি ভাইজানদের কথা আর নাই বা তুললাম। তাদের জিহাদী জজবাহ শেষ। ‘বাঁচলে শহীদ মরলে গাজী, আমরা সবাই মরতে রাজি…’ এখন দেখি সবাই পাজী! ফোক্কা আওয়াজ আর নেই। এখন আর কেউ বায়তুল মোকারমের উত্তর কিংবা দক্ষিণ গেইট থেকে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগানিস্তান’ চিৎকার দেয়ার সাহস পান না।
শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো দেশ থেকে জ্বালাও-পোড়াও ভাংচুরের রাজনীতি তিনি নির্মূল করেছেন। একসময় এক সাথে ৬৪ জেলায় বোমা ফাটানেওলাদের তিনি কিভাবে ঘাঁয়েল করলেন। এ এক মহা-আশ্চর্য্য ব্যাপার। রহস্যতো বটেই!
লেখক : কলামিস্ট।
আটলান্টা, জর্জিয়া।
|