1. muktokotha@gmail.com : Harunur Rashid : Harunur Rashid
  2. isaque@hotmail.co.uk : Harun :
  3. harunurrashid@hotmail.com : Muktokotha :
সমুদ্রদর্শনে আরও একবার - মুক্তকথা
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৩৮ পূর্বাহ্ন

সমুদ্রদর্শনে আরও একবার

কামরুল হাসান
  • প্রকাশকাল : রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১
  • ২৯৫ পড়া হয়েছে

কামরুল হাসান

(পর্ব ১৯)

প্রদীপের টমটমে চড়ে আমরা চলেছি ইনানী। আমরা মানে সেঁজুতি ও আমি। ওর মেয়ে তুতুকে আনতে পারল না বৃষ্টিবাদলের জন্য। আবহাওয়া শীতল, বাতাস আর্দ্র ও জলকণা ভরপুর। বেড়াবার জন্য চমৎকার আবহাওয়া। ডলফিন বা হাঙর যাই বলি না কেন, ইনানী যাবার কলাতলী মোড়টি ভারি আনইমপ্রেসিভ। সড়ক চলে গেছে এলোমেলো এলাকার মধ্য দিয়ে, এখানে অনেকগুলো হ্যাচারি, তাদের বেঢপ দেহ, মোটা ভুরি এসে পড়েছে সড়কের উপর, সরকারি জায়গার দখল নিতে তড়িঘড়ি করে বানানো বিভিন্ন স্থাপনাও আছে। সড়ক গেছে সেগুলো বাঁচিয়ে কোমর দুলিয়ে। কেউ ধারণাই করতে পারবে না ওই হতচ্ছিরি শুরুর একটু পরেই কী অনিন্দ্য প্রকৃতি ও নিসর্গ অপেক্ষা করছে। বস্তুত মেরিন ড্রাইভ ছিল কলাতলি থেকে সোজা, সমুদ্রের পাশ ঘেষেই। ক্রুদ্ধ সমুদ্র দুমড়ে-মুচড়ে নিয়ে গেছে তা, এই যে জনপদের পেটের খোঁড়লে ঢুকে গেল সমুদ্র সংলগ্ন সড়ক তা ওই ভাঙচুরের ফলাফল। রাস্তাটি সেখানে গিয়ে ওঠে যেখান আদি মেরিন ড্রাইভ তার গোড়ালি হারিয়েছে। কিংবা বলা যায় স্কন্ধচ্যুত মস্তক। এরপরে আর ঘিঞ্জিভাব নেই, এরপর সড়ক চকচকে খোলা তলোয়ার। শুরুর ওই জায়গাটি দেখে বীতশ্রদ্ধ আমরা দুজনেই। সেঁজুতি বলে সমুদ্র এতকিছু পারে, এসব সৌন্দর্যহীন অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে দিতে পারে না?

করোনার কারণে কক্সবাজার সহ সারাদেশে লকডাউন চলছে, মেরিন ড্রাইভ এমনিতেই জনবিরল, এখন আরো। একপাশে সমুদ্র, সড়কের পাশ ঘেষেই পাহাড় উঠে গেছে, কোথাও কোথাও ভূমিধসের সতর্কবার্তা। সেঁজুতি বল্ল, এই পাহাড়ে বানর ও টিয়াপাখি আছে। আমি ভাবি মনুষ্যবানরের উৎপাতে প্রকৃতির বানর আজও অবশিষ্ট আছে তাহলে? আর পাখিরাজ্যে সুনন্দ টিয়া যদি টিকে থাকে, তবে তো আনন্দের কথা। সেঁজুতি অভয় দেয়, আছে। এপাশে নিরেট পাহাড়ের দেয়াল, দেখার কিছু নেই, ওপাশে ঝাউবনের কাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে চলচ্ছবিময় সমুদ্র। সেঁজুতি বলে, ‘এই যে কেউ বলে, আমার সমুদ্র ভালো লাগে, কেউ বলে, আমার প্রিয় পাহাড়। আমার কিন্তু দুটোই ভাল লাগে।’ ‘আপনার?’ সে শুধোয় আমাকে। আমি বলি, আমারও দুটোই। কেননা দুয়ের দুপ্রকার রূপ। এ প্রসঙ্গে আমার একটি কবিতার শুরুটা সেঁজুতিকে শুনিয়ে দেই।
‘আমার লেগেছে ভালো বুকখোলা ময়ূর আকাশ
আমি কোনো পাহাড় নেব না।
তুমি নিও প্রিয় নীল সমুদ্র তোমার
বৃক্ষাবলী ওরা নিয়ে নিক এবেলা কি অন্য কোনো বেলা।’
সেঁজুতি বলে, বেশ তো! অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকায় ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ‘সংযোজনা ও ভাঙচুর’ কবিতাটির কিয়দংশ শোনাই,
‘এ ফুলটি নিচ্ছি এখন, অন্য ওটি থাক
এ দুটি বীজ বুনবো শুধু, যত্ন রৌদ্র, আত্তি বৃষ্টি
সবই পাবে এ দুটো বীজ,
আরগুলো সব খরায় শুকাক বা বৃষ্টিতে উঠুক ঢাউস ফুলে,
এ তিনটি জমি নিচ্ছি, সতর্কতার নিঁখুত বেড়ায় ঘিরব শুধু তিনটি জমি।

সমুদ্র এক নীলচোখা দেও, নীল আকাশের নীল ছেনালী ভাল্লাগে না,
পাহাড় ভালো, পাহাড় নিচ্ছি, বিশেষ কেবল এ পাহাড়টা…
সেঁজুতি বল্ল, আপনার দেখি বেশ মনে থাকে! বল্লাম এসব কবিতার প্রকাশ আমার জীবনে একেকটি মাইলফলক। তরুণ বয়সে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে দেশ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ ছিল স্মরণীয় ও বিপুল প্রণোদনাময়। যদিও এসব কবিতায় পাহাড়ের প্রতি পক্ষপাত আছে, আসলে আমার কাছে সমুদ্র কম প্রিয় নয়। পরপর আমার দুটি কবিতা শুনে সেঁজুতির মন্তব্য, আপনি ভালো কবি, আপনার আরও কবিতা লেখা উচিত। বস্তুত সেঁজুতির সৎ পরামর্শ হলো আমার ফিকশন লেখা উচিত, কেননা এসব ভ্রমণকাহিনী আমাকে টিকিয়ে রাখবে না, ফিকশন রাখবে। তার স্থির বিশ্বাস আমি সময়ের অপচয় করছি। আমাকে ভালোবাসে এমন বেশ কিছু কবি সাহিত্যিক আমাকে এইরূপ কথা বলেছে, আমাকে দ্বিধায় ফেলেছে। আমি তাকে বল্লাম, ফিকশন আমি যে লিখিনি তা তো নয়, ২০০৫ সালে আমার গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি বই প্রকাশের মতো গল্প আমি ইতিমধ্যে লিখে ফেলেছি, বেশ কিছু গল্প আছে অসমাপ্ত, যা সমাপ্ত করলে রচিত হতে পারে তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। শুনে সেঁজুতি বলে, সেটাই করুন। এই ভ্রমণঅভিজ্ঞতাগুলোকে গল্পে রূপ দিন। আমি জানি সে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, পরামর্শ আন্তরিকভাবেই দিচ্ছে। কিন্তু আমি যে প্রেমে পড়ে আছি ভ্রমণগদ্যের। তাকে বলি, এই কিছুকাল লিখব নন-ফিকশন, এরপরে ফিরে আসব ফিকশনে। ইচ্ছে আছে উপন্যাস লেখার।
একটা জায়গায় আমরা সমুদ্রকে ভালো করে দেখার জন্য, ছবি তোলার জন্য, থেমেছি। গত শীতে যখন এপথ দিয়ে গিয়েছি, সমুদ্র ছিল মায়াময় নীল। এখন তার চেহারা ঘোলাটে, কেননা আকাশ ঘোলাটে। সমুদ্র তো আকাশের আয়না, আকাশ নীল হলে সমুদ্র নীল, আকাশ ঘোলাটে হলে সমুদ্র ঘোলাটে। সমুদ্রের ছবি তুলে সেঁজুতি আসে একটি খাপখোলা তলোয়ারের মতো সড়কটির, দুপাশে তার সবুজ সরণি, ছবি তোলে। আমি আর কী ছবি তুলি, সেঁজুতি তোলে আরও বেশি। হিমছড়ির কাছে এসে আমরা ফের নেমে পড়ি, কারণ সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে, আকাশ হঠাৎই মেঘভারী আর মেঘগম্ভীর হয়ে উঠল, বেড়ে গেল বাতাসের বেগ। একটি সম্ভাব্য ঝড় দেখার শিহরণে আন্দোলিত হলাম। সাথে বজ্রবিদ্যুৎ থাকলে আরও ভালো। আমাদের কী হবে তা নিয়ে আমরা মোটেও ভাবিত হলাম না, ঝড়ের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা প্রস্তুত করে রাখলাম। ভুলেই গেলাম কী মিশন নিয়ে ইনানী যাচ্ছিলাম। মনে হলো আমরা বোধহয় সমুদ্রে ঝড় নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানাতে এসেছি।

কিছুপরেই মেঘ হালকা হয়ে এলো, গোমড়ামুখো ভাব কেটে স্মিত হাসি ফুটল আকাশ ঠোঁটে। একবার ভেবেছিলাম হিমছড়িতে চা পান করব, প্রদীপকেও ডাকব চা-পানে। কেননা এ্যালেগ্রো আর্ট গ্যালারি কাফেতে কাপাচিনো হেজেল নাট কফি পান হলো ব্যাতিক্রমী উদযাপন, রাস্তার পাশের দোকানে চা-পানই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু কী ভেবে মত পাল্টাই, এত দ্রুত স্বর্গ থেকে নেমে পড়া ঠিক হবে না, ইনানীর একটি ভালো চেহারার রেস্তোরাঁয় বসে চা-পান হবে মানানসই। আমাদের পতনরেখাটি হবে এইরূপ : এ্যালেগ্রো আর্ট গ্যালারি কাফে -> ইনানী রেস্তোরাঁ -> রাস্তার পাশের চা দোকান। বাতাসে বৃষ্টির ছাট ছিল না থামার আরেক কারণ। আমরা রাস্তার বাঁকে মারমেইড ক্যফে দেখতে পাই। সেখানে একটি জলনিমগ্ন মাঠ, ওপাশে ঝাউবন, ঝাউবনের ওপাশে বঙ্গোপসাগর। সরু খাল জলধারা নিয়ে গেছে সমুদ্রে; একটি পারাপারের কাঠের সেতু, জলে নিমজ্জিত তবে পুরোটা নয়, দুপ্রান্ত নিমজ্জিত, অনেকটা ওই সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার সেতুটির মতো, তবে সেই মহীরুহের কাছে এটি কিছুই নয়।

সেঁজুতি বড়ুয়ার মনে পড়ে গেল গত মার্চে মারমেইড ক্যাফেতে ঢাকা থেকে আসা কবি শেলী নাজের জন্মদিন পালনের স্মৃতি। বুফে ব্রেকফাস্টের দাম ছিল জনপ্রতি একহাজার টাকা। বাহ, ইনানী তো ব্রেকফাস্ট প্রাইসে ঢাকাকে ছাড়িয়ে গেল। তবে তারা ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ কোনটাই পায়নি, ডিনার পেয়েছিল। ‘কতজন ছিল দলে?’ দশজন শুনে অবাক হলাম। কেননা আমি জানতাম শেলী নাজের সাথে ইনানী এসেছিল কবি জুনান নাশিত। সেঁজুতিসহ কতজন হবে, ৩/৪ জন? শুধু মারমেইড ক্যাফে নয়, মারমেইড রিসোর্টের অনুরাগী সেঁজুতি। এরপরেই রেজু খাল। আমি প্রদীপকে বলেছিলাম এপাশে থামতে, কারণ ছবি তোলার চমৎকার সব দৃশ্য পাওয়া যাচ্ছিল। সে বল্ল, ‘ওপাশে গিয়ে থামি?’ সাধারণত এই সেতুতে দুটি বড়ো গাড়ি, ট্রাক বা বাস পাশাপাশি যেতে পারে না। একপ্রান্তের ট্রাফিক থামতে হয়, তাই যদিও ট্রাফিক কম, প্রদীপ চাইল সেতু পার হয়ে চলে যেতে। রেজু খাল বেশ প্রশস্ত, ইউরোপের বেশিরভাগ নদীর চেয়ে চওড়া, তার বুকভরা সুস্বাদু মাছ। উজানে পাহাড় আর ভাটিতে সমুদ্র সে পথিককে পথ হারানোর মন্ত্রণা উপহার দেয়। সেতুর উপর উঠে জলভরাখাল, তার তীরে ভেড়ানো সাম্পান, সমুদ্র ইত্যাদির ছবি তুলি, আমি ও সেঁজুতি। ট্রাফিক কম হলেও সেতুর উপরে চলাচল একটু ঝু্ঁকিপূর্ণ। স্টিলের ট্রাস (Truss) দিয়ে তৈরি রেজুখাল সেতু দেখে হাওড়া ব্রিজের কথা মনে পড়ে, যদিও কোনোভাবেই তুলনীয় নয়, তবু ইস্পাত শরীর আর ট্রাসগুলোর বিন্যাস দেখে মনে পড়ে যায়। যারা পায়ে হেঁটে পার হয়, তাদের জন্য মাঝে মাঝে ঝুলবারান্দা আছে চতুষ্কোণ। সেখান থেকে ছবি তুলি দুই দৃশ্যপাগল ফটোগ্রাফার। আমরা নিজেরা যদিবা খালে না পড়ি, ক্যামেরার পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

(চলবে)

এ জাতীয় সংবাদ

তারকা বিনোদন ২ গীতাঞ্জলী মিশ্র

বাংলা দেশের পাখী

বাংগালী জীবন ও মূল ধারার সংস্কৃতি

আসছে কিছু দেখতে থাকুন

© All rights reserved © 2021 muktokotha
Customized BY KINE IT