আব্দুল ওয়াদুদ, মৌলভীবাজার থেকে।। কুশিয়ারা নদীর পানি কমতে শুরু করায় মৌলভীবাজারে নদী পাড়ের ৪ ইউনিয়নসহ পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কাউয়াদিঘী হাওর পাড়ে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানা রোগ-বালাই। বিশুদ্ধ পানি না থাকায় বন্যার পানিই ব্যবহার করছেন তারা। এতে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগ। বিশেষ করে শিশুরা জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুব কম। রোগীদের তুলনায় সেবাও অপ্রতুল বলে অনেকেই বলেছেন। কুশিয়ারা তীরবর্তী রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ, ফতেপুর ও সদর উপজেলার মনুমূখ ও আখাইকুড়া ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রামের মানুষ এসব পানিবাহিত রোগের সাথে লড়াই করছেন। নদী পাড়ের খেটেখাওয়া মানুষ পার্শ্ববর্তী বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাজনগর হাসপাতাল ও মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এসব এলাকায় ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ ও ভাইরাস জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বানভাসি শিশুসহ সকল বয়সী নারী পুরুষ।
এদিকে বন্যাকবলিত অবহেলিত কাউয়াদিঘী হাওড় পাড়ের আমিরপুর (নোয়াগাঁও) গ্রামে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দুইদিনের ব্যবধানে একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই গ্রামের শতাধিক নারী শিশু জ্বরাক্রান্ত। এ দুই শিশুর মারা যাওয়ায় এলাকার মানুষদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত সোমবার রাতে ওই গ্রামের রুকুব মিয়ার মেয়ে তামান্না আখতার (৯) এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে মৃত্যুবরণ করে। এর দুইদিন পর রুকুব মিয়ার বোন রুমা বেগম (১৩) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মারা যায়। ওই গ্রামের কবরস্থান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় সদর ইউনিয়নের গড়গাঁও গ্রামে দাফন করা হয়েছে।
পানিবন্দি আমিরপুর গ্রামে এখনো কোন ত্রাণ দেয়া হয়নি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের নারী ও শিশুরা জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ওষুধ পৌঁছে দেয়ার জন্য মেডিকেল টিমকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়াও কামালপুর, আমনপুর, সুরিখাল, কেশরপাড়া, সুনামপুর,উমপুর, কান্দিগাঁও, বেড়কুড়ি, শাহাপুর, জাহিদপুর,রক্তা, অন্তেহরি, বাঘমারা, কেউলা, ধুলিজুড়াসহ পানিবন্দি গ্রামগুলোয় ভাইরাস জ্বর দেখা দিয়েছে। উপজেলার বন্যাপ্রবণ এলাকায় ৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। রোগীদের তাৎক্ষণিক প্যারাসিটামল, সেলাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. উত্তম কুমার শর্মা বলেন, উত্তরভাগ ইউনিয়নের বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে গত বুধবার মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছে। সেখানে ১শ’রও অধিক লোককে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আমিরপুর ও রক্তা গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্প করা হবে বলে জানা গেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত। এসব ইউনিয়নের জন্য পর্যাপ্ত ত্রান সামগ্রী মজুদ আছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ত্রান সামগ্রীসহ স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে আমিরপুর গ্রামে দুই শিশুর মধ্যে এক শিশু কিডনি রোগে মারা গেছে বলে তিনি জানান।
কুলাউড়া উপজেলায় বন্যা কবলিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ। কুলাউড়া হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ৫৭ জন রোগি ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নুরুল হক জানান, কুলাউড়া উপজেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মেডিকেল টিম রয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ ৫টি মেডিকেল টিম রয়েছে। হাকালুকি হাওর তীরে ভুকশিমইল ইউনিয়নে মেডিকেল টিমের পাশাপাশি একটি মোবাইল টিম কাজ করছে। তবে হাসপাতালে যেসব রোগি ভর্তি হচ্ছে এটা স্বাভাবিক।
এছাড়াও জুড়ী উপজেলায় হাকালুকি পাড়ের সোনাপুর ও বেলাগাঁও গ্রামে পানিবাহিত জ্বরে দুইশিশু মারা গেছে। হাকালুকি হাওরপারের বড়লেখা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ প্রায় ২৫ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৫ জন ভর্তি রয়েছে বলে জানা গেছে। পানিবন্দি মানুষের মাঝে রোগ-বালাই যাতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে না পারে সে জন্য গত ১ জুলাই ১০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়।