এনজিও দের সুদি ব্যবসা বহু খেটে-খাওয়া মানুষকে পথে নামিয়ে দিয়েছে
ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায়
সর্বহারা হতে চলেছেন
ট্রেন হকাররা
‘আমরা ট্রেনের মধ্যে লেবু, আনারস, চানাচুর ফেরি করে বিক্রি করি। কয়েক দিন ধইরা ট্রেন নাই। আমরা যারা হকারি কইরা জীবন চালাই, তারার বেশির ভাগের জমানো টাকা নাই। এই যে ১০-১৫ দিন ধইরা ট্রেন বন্ধ। আমাদের এখন অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। ঘরে খানি নেই হাতে টাকা-পয়সাও নেই। এভাবে আমরা হকাররা ছেলে-পুলে নিয়ে না খেয়ে মরমু।’
আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশনের একজন পরিচিত হকার। স্টেশনে ঘুরে আর ট্রেনের বগিতে রেলের যাত্রীদের কাছে লেবু-আনারস বিক্রি করেই তাঁর সংসার চলত। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৮ জুলাই থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁর মতো হাজারো হকারের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখা যায়, হকারদের বেশির ভাগই স্টেশনে নেই। কয়েকজন হকার প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছেন। কয়েকজন আমড়া ও চানাচুর নিয়ে বসে আছেন ক্রেতার অপেক্ষায়। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁরা খুবই বিপাকে পড়েছেন।
স্টেশনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশন ঘিরে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৩০টি দোকান আছে। স্টেশন ঘিরেই তাঁদের ব্যবসা। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৮ জুলাই থেকে তাঁদের আয়–রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে।
স্টেশনের পরিচিত একজন আমড়া বিক্রেতা বলেন, আগে ট্রেন চললে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০টি আমড়া বিক্রি করতেন। এখন স্টেশন ও আশপাশের এলাকা ঘুরেও ৫০টি বিক্রি করতে পারেন না। কোনো কোনো দিন বিক্রিই হয় না। দীর্ঘ দিন হকারি করায় অন্য কোনো কাজও পাচ্ছেন না।
স্টেশনে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন কয়েকজন মুচি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, দেশে কয়েক দিন পরপর বিশৃঙ্খলা হয়। আর বিপদে পড়েন তাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। স্টেশনে জুতা সেলাই করে দিনে এনে দিনে খান। এখন ট্রেন নেই, লোকজন নেই। তাঁদের আয়ও নেই। তাঁরা কত কষ্টে আছেন, তাঁদের খবর কেউ রাখে না।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রতিদিন শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন হয়ে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রামের কয়েকটি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। রয়েছে বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেনও। এই ট্রেনগুলোয় ঘুরে ঘুরে স্থানীয় অর্ধশত হকার মালপত্র বিক্রি করেন। ১৮ জুলাই থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় রোজগার নিয়ে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।
একজন হকার বলেন, ‘ট্রেন চললে গরিব মানুষ কিছু করে খেতে পারে। কেউ ট্রেনে জিনিস বিক্রি করেন। কেউ হাত পেতে চলেন। কেউ ট্রেনের যাত্রীদের জিনিসপত্র নামাইয়া দেন। এভাবেই অনেক গরীবের পেট চলে। এত দিন ধইরা ট্রেন বন্ধ। আমাদের আয় বন্ধ। আমরা মেহনত করিয়া চলি। এভাবে আর কত দিন যে চলতে পারুম বুঝতে পারছি না। ট্রেন বন্ধ হওয়াতে বহুত গরিব বিপদে আছে। আমরা সরকারের কাছে ট্রেন চালু করার অনুরোধ করি।’
মৌলভীবাজারে কারফিউ শিথিলের সময় বাড়লেও
আয়-রোজগারে মন্দা কাটছে না।
ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে জেলা শহর মৌলবীবাজারে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ চলমান থাকবে বলে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। জেলায় কারফিউ শিথিলের সময় গেল শুক্র ও শনিবার ১২ ঘণ্টা এবং রোববার ও সোমবার তা বাড়িয়ে ১৫ ঘণ্টা করা হয়েছে।
তবে কারফিউ শিথিলের মেয়াদ বাড়লেও মৌলভীবাজারে আয় রোজগারে মন্দা কাটছে না। এখনো জনজীবনে পুরোপুরি স্বস্তি ফিরে আসেনি। লোকজন ভয়ে ভয়ে চলাচল করছে। দোকানপাট খুললেও ক্রেতার উপস্থিতি খুবই কম। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।
সোমবার(২৯ জুলাই) দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, কাঁচা বাজারে সবজি, মাছ, মাংস, ফল ও মুদি দোকানে ভিড় থাকলেও কাপড়, জুতা, কসমেটিকস প্রভৃতি পণ্যের দোকানে ক্রেতা নেই।
ভরা মৌসুমে পর্যটন খাত এখন লোকসানের মুখে।
এদিকে পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গা চায়ের রাজ্য মৌলভীবাজার। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ভরা মৌসুমেও পর্যটক নেই এখানে। এর ফলে ধস নেমেছে পর্যটন খাতে। বাতিল হয়ে গেছে অনেক হোটেলের আগাম বুকিং। পর্যটন ব্যবসা স্থবিরতায় বেকার হয়ে পড়েছেন হোটেল ও পরিবহন শ্রমিকেরা। চলতি জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়েও পর্যটকদের কোলাহল ছিল জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে। এখন সেখানে সুনসান নীরবতা।
শ্রীমঙ্গলের একজন গাড়ি মালিক জানান, শ্রীমঙ্গল থেকে অন্তত ২০-৩০টি গাড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় পর্যটক নিয়ে বের হতো। কিন্তু এ পুরো সপ্তাহে একটি গাড়িও যায়নি। বেকার হয়ে পড়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। স্বাভাবিক অবস্থায় না ফিরলে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা থমকে যাবে।
একজন দিনমজুর বলেন, ‘কয়েকদিন ঘর থেকে বের হইনি কাজও পাইনি। দুদিন ধরে ভয়ে ভয়ে কাজে যাচ্ছি, এভাবে চললে খাবো কি?’
অপর একজন সবজি বিক্রেতা বলেন, ‘এখন সবজির আমদানি কম, ক্রেতাও নেই। তাই আয়-রোজগার কমে গেছে।’
পৌরশহরের কেন্দ্রীয় সড়কের একজন কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে সহিংসতা ও জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে, তাতে মানুষ এখনও আতঙ্কে রয়েছেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ যাচ্ছে।’
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সেলিম আহমেদ বলেন, ‘জুলাই মাসের শুরু থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত সব হোটেল রিসোর্টে ভালো পর্যটক ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে দেশে ছাত্র আন্দোলনে নিমিষেই সব শেষ হয়ে যায়। এ কারণে অনেক পর্যটক বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন। এতে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
জেলা বিজনেস ফোরামের সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, ‘এখনও মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক রয়েছে। তাই ক্রেতা মিলছে না। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি চাপে আছেন। অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণে জর্জরিত। আবার অনেকেই কর্মচারীদের বেতন ও দোকান ভাড়া কীভাবে মেটাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।’
লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, পর্যটন মৌসুমে হাজার হাজার পর্যটক দেখা যেত। বর্তমানে পর্যটকের দেখা নেই বললেই চলে।
অবশ্য জেলার সার্বিক অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে চলেছে বলেই অনুমিত হচ্ছে।