আনসার আহমদ উল্লাহ॥
গত ৪ মে আলতাব আলীর স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে এবং বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক সংগ্রামকে চিহ্নিত করে বার্ষিক আলতাব আলী দিবস পালিত হয়।
সন্ধ্যা ৬টায় পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে একটি স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়, কবিতা পাঠ করা হয় এবং আলতাব আলী এবং বর্ণবাদী সহিংসতার শিকার অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এক মিনিট নীরবতার পর, বাঙালি কমিউনিটি ও বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা তাদের বক্তব্যে বাঙালিদের বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের আন্দোলনকে স্মরণ করে এবং সকলকে সমতার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়।
১৯৭৮ সালের ৪ মে গার্মেন্টস শ্রমিক ২৪ বছরের আলতাব আলীকে হত্যা করা হয়। তিনি তার কাজ শেষ হওয়ার পরে বিকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। হোইটচ্যাপেলের এডলার স্ট্রিটে তাকে তিন বর্ণবাদী যুবক ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। তাকে স্থানীয় হোইটচ্যাপেল হাসপাতালে নেওয়া হলেও ডাক্তাররা তাকে মৃত গোষণা করে। এই হত্যাকাণ্ডে পর বাঙালিরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
অনুষ্টানটি সঞ্চালন করেন কালচার এন্ড রিক্রিয়েশন লিড কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন । “আলতাব আলীর নির্বোধ হত্যাকাণ্ড আমাদের সম্প্রদায়কে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু এমন একটি আন্দোলনকেও প্রজ্বলিত করেছিল যা স্তব্ধ হবে না,” ইভেন্টের হোস্ট কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন বলেন। “আজ আমরা তার স্মৃতি এবং তাদের সাহসকে সম্মান জানাই যারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং ‘আর নয়’ বলেছিল।”
উল্লেখযোগ্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটের স্পিকার জাহেদ চৌধুরী, ইকুয়ালিটি এন্ড সোশ্যাল ইন্ক্লুজন কাউন্সিলর সুলুক আহমেদ, কাউন্সিলর বদরুল চৌধুরী, বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হযরত আলী খান, আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের আকিকুর রহমান এবং আলতাব আলী ট্রাস্টের রফিক উল্লাহ, আকলাকুর রহমান ও হালিমা ইদ্রিস, স্ট্যান্ড আপ থেকে শীলা ম্যাকগ্রেগর, জুইশ সোসালিষ্ট গ্রুপের ডেভিড রোজেনবার্গ এবং টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্টারফেইথ ফোরাম থেকে সুফিয়া আলম।
পার্কের অনুষ্ঠানের পর, অংশগ্রহণকারীরা বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্বেষণে একটি প্রদর্শনী দেখার এবং চ্যানেল ৪ এর ডকুমেন্টারি ‘ডিফিয়েন্স’-এর স্ক্রীনিংয়ের জন্য ব্র্যাডি আর্টস সেন্টারে চলে যান। স্বাধীনতা ট্রাস্টের কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট জুলি বেগম, আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের আকিকুর রহমান এবং ডিফিয়েন্সের সিরিজ ডিরেক্টর সতীয়েশ মনোহারাজাকে নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় । প্যানেলের সভাপতিত্ব করেন লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির ডা. লায়লী উদ্দিন।
“অর্গ্যানাইজেশন ফর দ্য রিকগনিশন অব বাংলা”র
“বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার সংগ্রামের উদ্যোক্তা ও নেতৃত্ব দানকারী বৈশ্বিক সংগঠন ‘অরগ্যানাইজেশন ফর দ্য রিকগনিশন অব বাংলা এ্যাজ এন অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশনস’ কেন্দ্রীয় সংসদের প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত, বৃটেনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডঃ তোজাম্মেল টনি হক এমবিই যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম নগরীতে গতকাল ৯ মে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে শেষ নিঃশ্বাস করেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর। মৃত্যুকালে তিনি সহধর্মিণী মিসেস হক এবং এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন।
যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী বার্মিংহামে অভিবাসী তোজাম্মেল টনি হক পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। বার্মিংহামের একটি সেকেন্ডারি স্কুলের হেড টিচার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭১ সালে বৃটেনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক হিসাবে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
রাষ্ট্রপতি জেনারেল হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের আমলে তিনি ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করেন। কূটনীতিক-এর দায়িত্ব পালন শেষে তোজাম্মেল টনি হক এমবিই জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো(UNESCO)-এর এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিয়নে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
উল্লেখ্য, তোজাম্মেল টনি হকের দেশের বাড়ি রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায়। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি সপরিবারে বার্মিংহামে অভিবাসী ছিলেন।
শোক ও সমবেদনা:
“অর্গ্যানাইজেশন ফর দ্য রিকগনিশন অব বাংলা এজ এন অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস” কেন্দ্রীয় সংসদের প্রেসিডেন্ট তোজাম্মেল টনি হক এমবিই’র মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বৃটেনে বাংলাদেশের সম্মানিত হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনীম।
‘অরগ্যানাইজেশন ফর দ্য রিকগনিশন অব বাংলা এ্যাজ এন অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশনস’ কেন্দ্রীয় সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট কে এম আবু তাহের চৌধুরী এবং সেক্রেটারি জেনারেল তফজ্জুল হোসেন চৌধুরী।
এক শোকবার্তায় নেতৃদ্বয় মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
সংগঠণের পক্ষে আরো শোক প্রকাশ করেছেন -প্রেস সেক্রেটারী শেখ মোঃ মফিজুর রহমান, কামরুল হাসান চুনু, ফয়জুর রহমান চৌধুরী এমবিই, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল ক্বাইয়ুম কয়ছর, আবু তাহের এমবিই, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মসুদ আহমদ ও অরগ্যানাইজেশন ফর দ্য রিকগনিশন অব বাংলা এ্যাজ এন অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশনস’ সাউথ ওয়েলস কমিটির প্রেসিডেন্ট ও ইউকে বিডি টিভির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মকিস মনসুর।
দেশমাতৃকার মু্ক্তির লক্ষ্যে নিজ সন্তানকে উৎসর্গ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সব মুক্তিযোদ্ধাদের মা। আর একাত্তরেরঘাতকদের বিচারের দাবিতে গণআদালত গঠন করে বাঙালির হৃদয়ে তিনি জ্বেলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিখা।তাঁর মৃত্যু নেই, বাঙালির হৃদয়ে তিনি অমর হয়েই থাকবেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মদিনউপলক্ষে গত ৩’রা মে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল স্মরণ সভায় এমন মন্তব্যই উঠে আসে বক্তাদের মুখে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখা আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিতিছিলেন সংগঠনের দুই উপদেষ্ঠা, ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মাহমুদ এ রউফ ও রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাআবু মুসা হাসান।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি সৈয়দ আনাস পাশার সভাপতিত্বে ও সাধারণসম্পাদক মুনিরা পারভিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনেরসাবেক সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, সহ সভাপতি, সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমীন, সহ সভাপতি এবং ওয়েলসেরসভাপতি মোহাম্মদ মকিস মনসুর, সহ সভাপতি জামাল আহমেদ খান, সহ সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রাজ, সাংগঠনিক সম্পাদক সুশান্ত দাশ প্রশান্ত, গোলাম কিবরিয়া প্রমূখ নেতৃবৃন্দ।
বক্তারা, শহীদ জননীকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অন্যতম অভিভাবক মন্তব্য করে বলেন, নিজের সন্তানকে যুদ্ধে উৎসর্গের এই তুলনাহীন আত্মত্যাগ এক নজিরবিহীন উদাহরণ। বক্তারা শহীদ জননীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অতন্দ্র প্রহরী আখ্যায়িত করে আরো বলেন, যখনই জাতির পতাকা খামচে ধরতে চেয়েছে সেই পুরোনো শকুন, তখনই তিনি এদের প্রতিরোধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নেমেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে ঘাতকদের প্রতীকী বিচার করেছিলেন।
একটি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত শহীদ জননীর চেতনায় কাজ করার উপরগুরুত্বারোপ করে বক্তারা বলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখতে পারলে এদেশের কল্যাণের জন্য ত্যাগ স্বীকারে ইচ্ছুক মানুষের অভাব হবে না। তিনি বলতেন, ‘এই প্রজন্মেরমধ্যেই লুকিয়ে আছে আগামী দশকগুলোর যোগ্য প্রতিনিধি’। আর সে লক্ষ্যেই এ প্রজন্মকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘জেনো, সাহসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।’
বক্তারা আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও মৌলবাদীরা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়। তাই জাহানারা ইমামের জন্মবার্ষিকীতে আসুন আমরা আবার শপথ নেই যে, তিনি যে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে গিয়েছিলেন সেই লড়াই আমাদের এগিয়ে নিতে হবে।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে যুক্তরাজ্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনিরা পারভিন কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে শহীদ জননীকে স্মরণ করেন।