আব্দুল ওয়াদুদ।। মৌলভীবাজার: বুধবার, ৪ঠা মাঘ ১৪২৩।। মৌলভীবাজার জেলায় প্রায় শতবর্ষ আগ থেকে বিভিন্ন ধরণের মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই সব মেলা বিভিন্ন দিবস, ব্যক্তি ও ঘটনাকে উপলক্ষ করে অনুষ্ঠিত হয়। জেলা সদর ও বিভিন্ন উপজেলায় অনুষ্ঠিত এসব মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা অংশগ্রহন করেন। এসব মেলার মধ্যে শাহ মোস্তফার মেলা নিজস্ব বৈশিষ্টে সরগরম থাকে। মৌলভীবাজার শহরের শাহমোস্তফা সড়কস্থ হযরত শাহমোস্তফার মাজার অবস্থিত। এই মাজারকে উপলক্ষ করে প্রতি বছর পহেলা মাঘ বিরাট মেলা বসে। মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হয়। পসারিরা বিভিন্ন ধরনের পসরা নিয়ে বসে। স্থানীয়দের কাছে এটি শাহমোস্তফার মেলা বলে সুপরিচিত। মেলা দুদিন ব্যাপী চলে।
অজ্ঞান ঠাকুরের মেলা: মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে এক সাধক পুরুষ অজ্ঞান ঠাকুরের মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের চারদিকে মন্দিরের নিজস্ব প্রায় ৩০/৪০ শতক জমি আছে। এই সাধক পুরুষের মন্দিরকে ঘিরে প্রতিবছর পৌষ মাসে মেলা বসে। এ মেলায়ও প্রচুর লোক সমাগম হয়। মেলায় বিভিন্ন ধরণের বাঁশ, বেত ও মাটির তৈরি পণ্যের দোকান বসে। বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহি মেলা প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে। মন্দিরের পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে মন্দিরের ভাব, গাম্বির্য্য ও ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে। বিদ্যালয় স্থাপন করায় মেলার স্থান সংকোচিত হয়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মত মেলা বসে না। বর্তমানে মন্দির রক্ষনাবেক্ষনের দ্বায়িত্বে কেউ নেই।
মাধবকুন্ড বারনী মেলা: বড়লেখা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মাধবকুন্ড অবস্থিত। এই কুন্ড হিন্দুদের একটি তীর্থ স্থান। এখানে প্রতি বছর কার্তিক মাসের শেষের দিকে হাজার হাজার হিন্দু পূণ্যস্নানের জন্য সমবেত হয়। এই স্নানকে বারনি স্নান বলে। এই বারনি স্নানকে কেন্দ্র করে এখানে বারনি মেলা বসে। এই মেলায় জাত-ধর্ম নির্বিশেষে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। দু দিন ব্যাপী এ মেলা চলে।
পাঁচগাও দূর্গা পূজা মেলা: রাজনগর সদর উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাও গ্রামে সর্বানান্দ দাশের বাড়িতে প্রতিবছর এক ব্যতিক্রমধর্মী দূর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। ধর্মপ্রান হিন্দুরা এই পূজাকে জাগ্রত পূজা বলে। এই পূজাকে কেন্দ্র করে এখানে বিরাট মেলা বসে। তিনদিন ব্যাপী এই মেলা চলে।
বিষ্ণুপদ ধামের মেলা: রাজনগর উপজেলার তারাপাশা গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি তীর্থস্থান আছে। এই তীর্থের নাম বিষনুপদ ধাম। প্রতিবছর এখানে চৈত্রমাসে দোল পূর্ণিমার পূণ্যতিথিতে বাৎসরিক মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই মহোৎসবে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়। এখানে রত যাত্রা, রাস যাত্রা, ঝুলন যাত্রা ও দোল যাত্রার আয়োজন করা হয়। এই উপলক্ষে এখানে বিরাট মেলা বসে। জাত, ধর্ম নির্বিশেষে মেলায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
লালবাগ বারনি মেলা: প্রতিবছর কুলাউড়া উপজেলার লালবাগ গ্রামে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শত বছর ব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় বিভিন্ন ধরণের পসরা ছাড়াও পুতুল নাচ ও সার্কাস দেখানো হয়।
মহররম উপলক্ষে মেলা: প্রতিবছর কুলাউড়া উপজেলার পৃথিম পাশার নবাব বাড়িতে আশুরা উপরক্ষে এক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী মেলায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
ছয়শ্রী মেলা: প্রতিবছর কমলগেঞ্জর ছয়শ্রী গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চড়ক পূজার আয়োজন করে। এ পূজা উপলক্ষে এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। ঐতিহাসিক ছয়শ্রী দিঘীর পাড়ে এই মেলা বসে। মেলা একদিন পর্যন্ত থাকে।
মনীপুরীদের রাসলীলা: কমলগেঞ্জর মনীপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাসলীলা। প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথমদিকে মাধপপুর জোড়া মন্ডপে এই রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই রাসলীলাকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশী দর্শণার্থিরা সমেবেত হন। এ উপলক্ষে একদিন ব্যাপী মেলা বসে।
বৈশাখী মেলা: প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বটতলার পৌষ সংক্রান্তি মেলা: সদর উপজেলার সিংকাপন গ্রামে বটতল মাঠে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় ঐতিহ্যবাহী হাডুডুডু খেলা ও ঘোড় দৌড় প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলা প্রতিবছর পৌষ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলায় প্রচুর দর্শক সমাগম হয়।
ফকির মেলা: জেলা সদরসহ ও আশপাশের বিভিন্ন পীর-ফকিরের মাজারকে কেন্দ্র করে ফকির মেলা বসে। মেলা গুলো হচ্ছে-পীর শাহবুদ্দিনের মেলা, শেখ কামাল উদ্দিনের মেলাসহ অনেক।
শ্মশান ঘাটের মেলা: মৌলভীবাজার শহরের মনুনদীর তীরে শ্মশানঘাটে চৈত্র বিদায় উৎসব, চড়ক পূজার মেলা ও শ্মশানকালীর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার স্থায়ীত্ব একদিন।
মাছের মেলা: এই মেলা একটি নজিরবিহীন মেলা। এ ধরণের মেলা বাংলাদেশের কোথাও নেই। সদর উপজেলার শেরপুরের কুশিয়ারা নদীর তীরে এই মাছের মেলা বসে। মাঘ মাসের প্রথমদিকে এই মেলার আয়োজন করা হয়। মেলার একমাত্র বৈশিষ্ট হলো- মেলায় মাছ ছাড়া আর অন্য কোন পণ্য বিক্রি হয়না। ওখানে বিরাট এলাকা জুড়ে চোখে পড়ে শুধু মাছ আর মাছ। বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ বিশাল আকৃতির রুই, বাঘ, বোয়াল, চিতল ও ঘাগটি মাছ দেখা যায়। দেশে কত প্রজাতির মাছ আছে তা এ মাছের মেলায় দেখা যায়। মেলা দেখা ও মাছ কেনার জন্য মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অগনিত মানুষের সমাগম ঘটে। এ মেলার স্থায়ীত্ব তিন দিন। উল্যেখ্য, শুধুমাত্র মাছ কেনা-বেচা হয় বলে এই মেলার নাম মাছের মেলা।