হারুনূর রশীদ।।
সময়টি ছিল ১৮৫৭ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর। বাদশাহী ভারতের মৃত্যুঘন্টা এদিন বেজে উঠেছিল। একই সাথে বেজে উঠেছিল পরাধীনতার জিঞ্জিরের ঝঁনঝঁনানি। বাহাদূর শাহ জাফর, শুধু দিল্লীর নয়, কাগজে-কলমে হলেও সারা ভারতের তখনও শাহেনশাহ ছিলেন। কোম্পানী শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। খুবই দ্রুত সারা ভারতে ছড়িয়েও পড়ে। বিদ্রোহীরা দিল্লী নগরী দখল করে নেয়। দখলের পর কাকে নেতৃত্বের চেয়ারে বসাবে। সবকিছুতেই তো একজন নেতার প্রয়োজন। নেতৃত্বহীন বিদ্রোহীরা ত্যক্ত-বিরক্ত অনিচ্ছুক বৃদ্ধ মোগল বাহাদূর শাহ জাফরকে তাদের নেতা ঘোষণা করে। দখল ও নেতা ঘোষণার পর বিদ্রোহীরা দিল্লী শহরে লুকিয়ে থাকা ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এ অভিযানে ৫২জন ইংরেজ নিহত হয়। সময়টি ছিল ১৮৫৭সালের ১৬ই মে।
এ ঘটনার বেশ পরে ইংরেজরা যখন গোর্খা ও শিখদের সহায়তায় বিদ্রোহীদের পরাজিত করে দিল্লী দখলে নিয়ে গেল; তারা ১৮৫৭সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর লাল কেল্লার দেওয়াল ভেঙ্গে রাজবাড়ীতে ঢুকে যায়। ৪০ হাজার বাদশাহী ফৌজ কোন কিছুই করতে পারেনি। বাহাদূর শাহ জাফর তখন পরিবারের লোকজন সহ ৫/৬ হাজার নিজস্ব বাহিনীর লোকজন নিয়ে হুমাইউনের কবরে আশ্রয় নেন। স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজরা ধরে নিল শাহেনশাহ বাহাদুর শাহ জাফরই এই বিদ্রোহের নেতা। তাকে তারা জীবিত অবস্থায় আটক করে হুমাইউনের কবর খানা থেকে।
বেনিয়া ইংরেজ মেজর উইলিয়াম স্টেফেন রেইকস হডসন তখন লালকিল্লা ঘেরাও করে ঘোষণা দেয়- কেউ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাকে হত্যা করা হবে। এক হাতে হুমকি রেখে ভিন্ন হাতে রাখে বাহাদূর শাহের প্রান। জানায় যে, ফিরিয়ে দেবে শাহেনশাহ্ এর প্রান যদি তিনি জীবীত ধরা দেন। এ ধূর্তামী করতে গিয়ে সে সফলও হয়েছিল।
মোগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় শেষ শক্তিমান মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর মৃত্যুর পর থেকে। ১৭০৭খৃঃ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আওরঙ্গজেবই একমাত্র মোগল সম্রাট যিনি সারা ভারত শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ধুরন্দর শিখ ও দস্যু প্রকৃতির মারাঠারা বিভিন্ন সুযোগে শক্তিসঞ্চয় করতে থাকে। খুবই ধূর্তার সাথে বিদেশী ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে খুবই ধীরলয়ে দিল্লীর শাসন সঙ্কুচিত করে আনতে থাকে। ১৭৬৪খৃঃ মোগল সুলতান শাহ আলম বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পন করলে শুধুমাত্র দিল্লী ও তার আশ-পাশ এলাকা ছাড়া সর্বত্র তার কর্তৃত্ব হারান। এ সময় সম্রাটকে ব্যঙ্গ করে ইংরেজ-মারাঠিরা কথা প্রচার করেছিল-“সুলতান-ই-শাহ আলম, আয দিল্লী তো পালাম”। অর্থ হলো, সারা দুনিয়ার বাদশাহ আলম, বাদশাহী তার দিল্লী থেকে পালাম। পালাম দিল্লীর কাছেই বর্তমান বিমান বন্দর এলাকা।
এমন অবস্থার পরও ইংরেজদেরক গোটা ভারতের শাসন ক্ষমতা অধিকার করতে বহু দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশ্য সময় তারা নষ্ট করেনি। লুন্ঠনকাজ ঠিকই চালিয়ে গেছে। সুধুমাত্র ন্যায়পরায়ন সম্রাটদের শৌর্যবির্যের আদিপত্যের কারণে তাদেরকে ৯৩ বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
দিনটি ছিল সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ। ধূর্ত মেজর হডসন ছোট একদল শিখ সৈন্য নিয়ে হুমাউনের কবরে যায়। সে সম্রাটের ৪/৫ হাজার নিজের মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকা ৩জন সম্রাটপুত্রকে নিতে চায়। সম্রাটপুত্রদের নিরাপত্তার বিষয়ে অস্বীকৃতি জানালে সম্রাটের সৈন্যরা ইংরেজদের সাথে লড়াই করতে চায়। কিন্তু সম্রাটপুত্র গন ভাবেন ভিন্ন। তারা মনে করেছিলেন সম্রাট যুদ্ধে হেরেগিয়ে কবরে স্থান নিয়েছেন। নগরী ইংরেজদের দখলে। সুতরাং যুদ্ধতো শেষ। আমরা পরাজিত। আমাদের বিচার হবে। হোক। এমন সরল ভাবনা থেকে তারা তাদের ছোট বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে না গিয়ে মেজর হডসনের কাছে এসে দাড়ান। হডসন তাদের একটি গরুর গাড়ীতে উঠতে নির্দেশ দেয়। তারা উঠে বসেন। তাদেরকে বিখ্যাত সেই চাঁদনী চক বাজারের ভেতর দিয়ে ইংরেজদের পুলিশ চৌকিতে নিয়ে যায়। এ চৌকি তারা ইতিমধ্যেই তাদের দখলে নিয়ে নিয়েছিল। প্রথম প্রথম বেশ কিছু মানুষ নবাবপুত্রদের সাথে সাথে কিছু পথ হেটে হেটে এসেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সকলেই চলে যায়। বেইমান মেজর হডসন চাঁদনীচক কোতওয়ালীতে এনে নিজ হাতে ৩জন সম্রাটপুত্রকে গুলি করে হত্যা করে। এর পরের কয়েকদিনে দুরাচার হডসন ছোট বড় ২১জন সম্রাটপুত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং ফাঁসীতে ঝুলায়। এভাবেই ৩শত বছরের মোগল শাসন শেষ হয়ে আসে। বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের বিচার হয়। তাঁকে ব্রহ্মদেশের রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়া হয়। সেখানেই তিনি মুত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের শেষ সময় খুবই সাদাসিদে জীবন কাটিয়ে গেছেন। এভাবেই শেষ হয়ে যায় দুনিয়া কাঁপানো মোগল সাম্রাজ্যের।