মৌলভীবাজার থেকে আব্দুল ওয়াদুদ,
কয়েক যুগ ধরে মৌলভীবাজার ছিল আগরের ভূস্বর্গ। তখন মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেট থেকে আগর আমদানীর ওপর নির্ভর ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, রপ্তানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা, কারখানায় জ্বালানি সংকট, আগর পরিবহনে নানান ঝামেলা প্রভৃতি কারণে সংকুচিত হতে থাকে সম্ভাবনার আগর খাত। তবে গত এক যুগে সেই ধারা ক্রমেই বদলাতে শুরু করে। আগরকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে এ খাতের সম্প্রসারণে সরকার এগিয়ে আসায় পুরনো জৌলুস ফিরে পেতে থাকে আগরের বাজার। বিরাজমান কিছু সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হলে এ খাত থেকে বছরে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় শতাধিক বছর ধরে চাষিরা আগর চাষ করে আসছে। এ ছাড়া এ জেলার কুলাউড়া, কমলগঞ্জ উপজেলায় বহু বছর ধরে আগর চাষ হয়ে আসছে। এসব এলাকার অনেকেই বাপ-দাদার ধারাবাহিকতায় আগর চাষে জড়িত। বন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে শুধু সিলেট ও মৌলভীবাজারে আছে আগরবাগান। এ বিভাগের মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ১১১টি, কুলাউড়ায় ৬টি, কমলগঞ্জে ২টি আগরবাগান রয়েছে। পঞ্চাশের দশকের আগ পর্যন্ত আরও বেশিসংখ্যক বাগান ছিল। কিন্তু এর পর থেকে এ খাতকে ঘিরে ধরে নানা সমস্যা। আগর খাত শিল্প না হওয়ায় ঋণ সংগ্রহে জটিলতা, আগর রপ্তানিতে সনদ সংগ্রহে জটিলতা, কাঁচামাল সংকট, কারখানায় গ্যাস সংযোগ না থাকা প্রভৃতি সমস্যার কারণে আগরবাগান সৃজনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন চাষিরা। ফলে অনেক কারখানাই ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে। তবে এক যুগ ধরে আগর খাতকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে সরকার। সম্প্রতি এ খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে নতুন উদ্যমে আগর চাষিরা বাগান সৃজনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ১৯৯৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারিভাবে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর আগরবাগান সৃজন করা হয়েছে। এই সময়ে ব্যক্তি উদ্যোগে এর চেয়েও বেশি হেক্টর আগরবাগান সৃজন করা হয়েছে। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আর এস এম মুনিরুল ইসলাম জানান, সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হওয়ায় বন বিভাগ আগরবাগান সৃজনের পাশাপাশি আগর চাষি ও বাগান মালিকদের প্রশিক্ষণ এবং সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে আগর থেকে আতর উৎপাদনকৌশল শেখাচ্ছে। আগর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, এসব বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত আগর প্রক্রিয়াজাত করে চিপস (গাছের ভিতরের অংশ) ও তেল (আতর) আকারে বিদেশে রপ্তানি হয়। উৎপাদিত আগরের সবচেয়ে বড় বাজার এখন মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এ ছাড়া ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপানেও আগর রপ্তানি হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি আগর কাঠ (চিপস) মানের তারতম্য অনুযায়ী ১ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলারেও বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি আগর তেল (আতর) সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগর রপ্তানি করে বছরে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
বড়লেখার প্রায় শতাধিক পরিবার আতর উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রায় ১ হাজার পরিবার এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত রয়েছে। উঠানের এক পাশে আগরগাছ ফালি ফালি করে কাটা হচ্ছে, আরেক পাশে চলছে কাটা ফালি বা টুকরাগুলো থেকে পেরেক খোলার কাজ। আর ঘরের বারান্দায় বসে নারীরা ফালি কেটে ছোট্ট ছোট্ট টুকরা করায় ব্যস্থ। খানিক দূরে কারখানায় শ্রমিকেরা সারি সারি যন্ত্রে আগর জ্বাল দিয়ে আতর তৈরি করছেন।
বেঙ্গল পারফিউমারির আবদুল কুদ্দুসের নিজের বাড়ি ও কারখানায় এভাবেই আতর তৈরির কাজ মিলেমিশে একাকার। তিনি জানালেন, মাসে গড়ে ২০০ তোলা (এক তোলায় ১১.৬৬ গ্রাম) আতর হয়। ভালো মানের প্রতি তোলা আতর বিক্রি হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা দরে। মান একটু খারাপ হলে প্রতি তোলা আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পাওয়া যায়।
আবদুল কুদ্দুসের মতোই বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বাড়িতে বাড়িতে এমন কারখানা। গুনলে শ তিনেকের মতো হবে। তবে অধিকাংশই ছোট ও মাঝারি আকারের। এখানকার তৈরি আতর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। চাহিদা ভালো থাকায় প্রচুর পরিমাণে আগর কাঠও রপ্তানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসব কাঠ ধূপের মতো জ্বালিয়ে সুগন্ধি তৈরি করে।
শ্রীমঙ্গলের উপ-বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানান, সিলেট বিভাগের সংরক্ষিত বন ও পাহাড়ি অঞ্চলে লাভজনক হতে পারে এবং এর প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে সিলেট বনবিভাগ ১৯৯৬ সালে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কের অভ্যন্তরে ৫ হাজার আগর চারা রোপণ করে। পরীক্ষামূলক এ প্রকল্পের আশানুরূপ সাফল্যে সিলেট বনবিভাগ ১৯৯৮ সালে বৃহত্তর সিলেটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও উঁচু নিচু পাহাড়ি টিলায় ‘পরীক্ষামূলক আগর বনায়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। তিনি জানান, এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৯-২০০৫ সালে ৩৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬০ টাকা ব্যয়ে বৃহত্তর সিলেটে ৩০৪ দশমিক ১৬ হেক্টর জমিতে আগর চাষ করা হয়। এরমধ্যে জুড়ি-১ রেঞ্জে ৪৭ হেক্টর, জুড়ি-২ রেঞ্জে ৪৯ দশমিক ৩৩ হেক্টর, মৌলভীবাজার রেঞ্জে ৬৮ দশমিক ৮৩ হেক্টর, হবিগঞ্জ-২ রেঞ্জে ৫৭ হেক্টর, রাজকান্দি রেঞ্জে ৪২ হেক্টর, রঘুনন্দন রেঞ্জে ২৫ হেক্টর, কুলাউড়া রেঞ্জে ৫ হেক্টর এবং উত্তর সিলেট-১ রেঞ্জে ১০ হেক্টর আগর বাগান সৃজন করা হয়।
শ্রীমঙ্গলের উপ-বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরো জানান, পরবর্তীতে ২০০৬-২০১১ অর্থবছরে আগরবাগান সৃজন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) নামে আরেকটি প্রকল্পের অধীনে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন ৭৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৭২০ হেক্টর জমিতে আগর চাষ করা হয়। এরমধ্যে জুড়ি-১ রেঞ্জে ১৫০ হেক্টর, জুড়ি-২ রেঞ্জে ১৬০ হেক্টর, মৌলভীবাজার রেঞ্জে ৫৫ হেক্টর, হবিগঞ্জ-১ রেঞ্জে ১০০ হেক্টর, হবিগঞ্জ-২ রেঞ্জে ৪০ হেক্টর, রাজকান্দি রেঞ্জে ১৫৫ হেক্টর, কুলাউড়া রেঞ্জে ১০ হেক্টর এবং উত্তর সিলেট-১ রেঞ্জে ৪০ হেক্টর ও উত্তর সিলেট-২ রেঞ্জে আগর বাগান সৃজন করা হয়।
বিভাগীয় বনকর্মকর্তা জানান, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে প্রায় ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে সাতছড়ি রেঞ্জে ৪০ হেক্টর এবং মৌলভীবাজার রেঞ্জে ৬০ হেক্টর জমিতে আগর চাষ করা হয়েছে। বনবিভাগ সূত্র জানায়, সিলেট বনবিভাগ বহুমূল্যবান খুশবুদার আতর তৈরি জন্য আগর ও এর কাঁচামাল উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। গত ফ্রেব্রুয়ারী মাসে বড়লেখা উপজেলার সুজানগরে বিখ্যাত আগর-আতর শিল্প পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কাতারের রাষ্ট্রদুত আহমেদ বিন মোহাম্মদ নাসের আল দিহাইমী। বড়লেখার আগর-আতরের বাণিজ্য সম্প্রসারণ বিষয় এবং এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কাতারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ব্যবসায়ীদেরকে অবহিত করবেন বলে তিনি স্থানীয় সংসদ ও সংসদের হুইপ মোঃ শাহাবুদ্দিন আহমদ কে আশ্বাস দেন।