‘৭১-র এপ্রিলের শুরুর দিকে দু’দিন সম্মুখযুদ্ধ হয় শেরপুরে। ঐতিহাসিক শেরপুর যুদ্ধের কথা তৎকালে বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার হয়। এই যুদ্ধে শহীদ হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সুনীল ভৌমিক, আজিম উদ্দিন মাস্টারসহ চার-পাঁচজন। এই সম্মুখ সমরস্থল, বীর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথাকে স্মরণীয় করে রাখতে শেরপুর গোলচত্বর এলাকায় জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ভাস্কর্য। এই চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বর। সম্মুখ সমরে যারা শহীদ হলেন, তাদের নাম কিংবা কোনো স্মৃতি এখানে সংরক্ষণ করা হয়নি। শ্রীমঙ্গলস্থ বিজিবি সেক্টরের নিকটবর্তী ভাড়াউড়া গণকবরে শায়িত বীর শহীদদের নামফলক লাগানো হয়নি। যেসব স্থানে স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বীর শহীদদের নামফলক লাগানো হবে এমনটা জানা গেছে।
রাজনগর পাঁচগাঁওয়ের গণকবর : ১৯৭১ সালের ১ মে থেকে পাকিস্তানি বাহিনী রাজনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যাকান্ড শুরু করে। এদিন হানাদার বাহিনী উপজেলার পঞ্চেশ্বর গ্রামে নগেন্দ্র নারায়ণ বিশ্বাস ও তার ভাতিজা মণি বিশ্বাসকে হত্যা করে। একই দিনে মুন্সীবাজারে লুটপাট চালায় এবং গ্রামে ঢুকে সনৎ ঠাকুর, ছায়া শীল, খোকা দেব, মুকুল দাস ও ডা. বনমালী দাসকে হত্যা করে। এছাড়াও উপজেলার ফতেপুর ও উত্তরভাগ ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদী পথে নদী পাড়ের সাদাপুর, তুলাপুর, সুনামপুর, যোগীকোনাসহ আরো বেশ কিছু গ্রামে ঢুকে তান্ডব চালিয়ে লোক ধরে নিয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৭ মে গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনারা প্রায় ৫০ জনের একটি দল দু’টি ট্রাকে করে পাঁচগাঁওয়ে ঢুকে। দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের লোকদের ধরে একটি দীঘির পাড়ে এনে হাত-পা বেঁধে এক জায়গায় জড়ো করে। গ্রামের ঘরে ঘরে তখন পাকিস্তানি সেনারা আগুন লাগিয়ে দেয়। এক সময় জড়ো করা গ্রামবাসীর শরীর থেকে কাপড় খুলে একজনের গলার সঙ্গে অন্যজনের পা বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় দীঘির জলে নিক্ষেপ করে। এরপর ভাসমান লোকদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্রাশফায়ার করে। হাত-পা বাঁধা ৫৯ জন গ্রামবাসী সেদিন এখানে শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে গ্রামবাসী স্বজনদের লাশ তুলে এনে দীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি গণকবরে মাটিচাপা দেন। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে সেদিন একটি লাশেরও দাহ করা সম্ভব হয়নি। পাঁচগাঁওয়ের হত্যাযজ্ঞে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন বসন্ত নমঃশূদ্র, উমেশ নমঃশূদ্র, সনাতন নমঃশূদ্র, নগবী শব্দকর, গোপাল শব্দকর, অভি শব্দকর, রমণ শব্দকর, নীরোদ শব্দকর, মশাই শব্দকর, ইরেশ শব্দকর, ব্রজেন্দ্র শব্দকর, সার শব্দকর, নিত্যবালা শব্দকর, নরেশ শব্দকর, পুতুল অধিকারী, ইরেশ মালাকার, উমেশ মালাকার, আদাই মালাকার, টনা মালাকার, পুতুল মালাকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি দেয়াল তুলে গণকবরের স্থানটি আলাদা করা হলেও, এখন পর্যন্ত একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যায়নি।
মৌলভীবাজার প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র(পিটিআই): মৌলভীবাজার প্রাইমারি টিচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে(পিটিআই) ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার। এখানে জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। এখনও মুখে মুখে শোনা সেই নির্যাতনের কাহিনী বলে অনেকেই আচমকা শিউরে ওঠেন। ‘মৌলভীবাজার পিটিআইতে পাকিস্তানি মিলিটারির টর্চার সেল ছিল। এখানে অনেকের ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্তমান বিডিআর ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প। অনুমান সেখানেই মুক্তিযোদ্ধা সুদর্শন, মুকিত, রানু, সমীর, শহীদ ও সোমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
|