মুক্তকথা প্রতিবেদন।। বিভিন্ন উপলক্ষে সুযোগ পেলেই এখনও ইরেজগন দাবী করতে চান যে ভারতীয়দের সভ্য-সংস্কৃতিবান করতে গিয়ে তাদের প্রায় ২’শ বছর ভারতে থাকতে হয়েছে। এ ধরনের কথা যে ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মত হাসির খোরাক জুগায় তা তারা নিজেরাও বুঝেই মনে হয় এমন বলে থাকে। তাদের মনে হয়তো সেই গোয়েবলসীয় কৌশল কাজ করে যে কোন একটি মিথ্যাকথা বছরের পর বছর ধরে প্রচার করতে থাকলে একসময় কিছু না কিছু মানুষ অবশ্যই বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে প্রচারিত কথাটি ঠিক।
আদর্শগত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যদি ধরেই নেই যে, অসভ্যদের সভ্য করতে গিয়েই ইংরেজগনকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২শত বছর থাকতে হয়েছিল। তা’হলে সেখানে অসংখ্য ইংরেজ বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠী থাকার কথা। কিন্তু কই! তেমন কোন নজিরতো গোটা উপমহাদেশ ঘুরেও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপ, ভারত এমনকি সুদূর আফগানিস্তান ঘুরে কোথায়ও হাজার হাজার তো দূরের কথা শত শত ইংলিশ মানুষের স্থায়ী বসবাসের কোন চিহ্নই পাওয়া যাবে না।
দিল্লীর আদালতে সম্রাট জাহাঙ্গীর। উপরে ডানে সম্রাটের আবক্ষচিত্র। ছবি: ইন্টারনেট |
ইংরেজ বা বৃটিশগন প্রথম ভারতে আসে ১৬০৭সালে। সময়টি ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের সূচনাকাল।
তারা এসেছিল ভারতের সাথে ব্যবসার সুযোগ খুঁজে দেখার জন্য। পরবর্তী শতবর্ষ জুড়ে ইংরেজ বণিকরা ভারত থেকে হরেক কিছিমের মাল-সামগ্রী আমদানী করে লণ্ডনে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করেছে। সে সময় এ রপ্তানী থেকে ভারত বিশাল অংকের উদ্বৃত্ত ব্যবসা করতো। কারণ ভারতকে তেমন কোনো পণ্য লণ্ডন থেকে আমদানী করতে হতো না। এ সময় ভারতকে সভ্য করার কোন মিশনের খবর পাওয়া যায় না ইতিহাসের কোন একটি ছেঁড়া পাতায়ও। কারণতো এটাই যে ভারত তখনই একটি উন্নত সভ্যতার দেশ ছিল।
মূলতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সকল সূচক থেকেই দেখা যায় ভারত তখন ইউরোপ থেকে অনেক অনেকগুণ উপরের জীবন যাপন মাত্রায় বসবাস করতো। সময় গত হওয়ার সাথে সাথে ইংরেজরাও বুঝতে সক্ষম হলো যে মোগল ভারত সারা বিশ্বের মাঝে অধিক সংখ্যক স্থলবাহিনীর অধিকারী। এবং বৃটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতীয় রাজনীতি থেকে একেবারেই বাহিরে থাকা মামুলী এক ব্যবসায়ী দল।
সে সময় ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় জলদস্যুদের উপদ্রব ছিল দূর্দমনীয়। অলন্দাজ জলদস্যু, পর্তুগীজ জলদস্যু, ইংরেজ জলদস্যু, মগ জলদস্যুরা ভারত সাম্রাজ্যকে নেস্তে নাবুদ করতে শুরু করেছিল।
অনেক অনেক দিন পরের কথা। গঙ্গা-যমুনায় তখন অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। বিশ্ব মানচিত্রে তখন অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ইতিহাসের মহভারতের ক্ষমতায় তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব। ক্ষমতা পাওয়ার পর আওরঙ্গজেব জলদস্যু দমনে বিশেষ পদক্ষেপ নেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ভারতে ইংরাজদের উপস্থিতি নিয়ে। হেনরি এভেরি নামের এক বৃটিশ জলদস্যু আরো ৫জন কেপটেনকে সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে আক্রমন করে বসলো এক ভারতীয় জাহাজে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর গোপনে পাঠানো তথ্যের উপরই সেই জলদস্যু এই ঘটনা ঘটিয়েছিল। তথ্য ছিল এই যে ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ নামের এই জাহাজটি সম্রাট আওরঙ্গজেবের কোষাগার। এটি ছিল সে সময় পর্যন্ত দুনিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৌ-ডাকাতি। করেছিল ইংরেজ জলদস্যুরা।
‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ জাহাজে তখন ৫লাখ সোনা ও রূপার টুকরা মওজুদ ছিল। ১৬৯৫ সালের সেই সময়ে এর বাজার মূল্য ৬লাখ ৫০হাজার পাউণ্ডের উপরে ছিল বলে কৌড়ায় একজন লিখেছেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব অবশ্য ডাকাতির খবর শোনামাত্রই যোগ্য জবাব দিলেন। নির্দেশ দিলেন আবিসিনীয় সৈনাধ্যক্ষ সিদ্দি ইয়াকুবকে। বৃটিশ ব্যবসার কারখানাগুলি আক্রমন করে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সেদিন। তিনি ভারতীয়দের পক্ষে বিজয়ের সূচনা করলেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ ‘শিশুযুদ্ধ’(Child’s War) বলে ইতিহাসে খ্যাত। বৃটিশরা অবশ্য সম্রাটের রোষকে শান্ত করার জন্য বহু চেষ্টা করেছিল এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিপূরণেরও প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল বিশ্বের এতোবড় নৌডাকাতি সংগঠিত হয়েছিল যে এর প্রতিক্রিয়ায় সম্রাট বাহিনী মূল অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় আনার জন্য আধুনিক দুনিয়ার মত করে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। দুষ্কৃতিকারীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য সেই ঘোষণা খুব কাজও দিয়েছিল।
অবশেষে ইংরেজরা সম্রাটের কাছে মোগল ভারতে তাদের ব্যবসার অধিকার রক্ষার জন্য করজোরে আবেদন জানালো। ইংরেজদের আত্মসমর্পনের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোগল ভারত তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়নি। ঠিক এরই ৬২ বছর পর দৃশ্যতঃ উল্টো ঘটনা ঘটেছিল ভারতের ইতিহাসে।
এই ‘শিশুযুদ্ধ’ ছিল মূলতঃ বৃটিশ ও মোগল ভারতের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের কাল ১৬৯৫-৯৯ সাল অবদি। সফল বোম্বে অবরোধ ও ইংরাজদের আত্মসমর্পণের পর মোগল ভারত বিশ্ববিজয়ী হয়ে উঠতে পারতো। ১৭০৭ সালের দিকে মোগল ভারত ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক তথা শৌর্য্য-বির্য্যের দিক থেকে তাদের শীর্ষে পৌঁছেছিল। এরপরও একই সময়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায় এমনকি মুসলমানদেরও একটি ক্ষুদ্র অংশের বিরুদ্ধে সম্রাট আওরঙ্গজেবের জাতিগত বিদ্বেষ ও নিষ্পেষন নীতি ভারতের একক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মূলতঃ শেষ করে দিয়েছিল। দু’টি বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। উত্তর-পশ্চিমের শিখ বিদ্রোহ ও পশ্চিমের মারাঠা বিদ্রোহ যা শেষাবদি ধীরে ধীরে একই রাষ্ট্র চিন্তার ভারতকে বিভক্ত করে দিল। ১৭৭০ এর দিকে মোগল ভারত মুলতঃ ‘মারাঠা সাম্রাজ্যে’র রক্ষকরাজ্য হিসেবে বেঁচে রইলো।
বৃটেনের পদত্যাগী পররাষ্ট্র সচিব বা মন্ত্রী বরিস জনসন এই সেদিনও বলেছেন আজকের বৃটেনের আমরা ‘রিভার্স কলোনিয়েলিজম’ এর সুফল ভোগ করছি।
কৌড়া ডাইজেস্টে একজন লিখেছেন ইংরেজরা ভারতীয়দের সভ্যতা শিখিয়েছে বলে দাবী করে। কোথায় অপর এক জায়গায় আরেকজন লিখেছেন, ইংরেজদের কারণেই মোগল ভারত আজ দুনিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্রদের একটি ‘ইণ্ডিয়া’ হতে পেরেছে। তথ্য সূত্র: কৌড়া ডাইজেস্ট ও এশিয়ান এণ্ড আফ্রিকান ষ্টাডিজ ব্লগ। সংগ্রহ ও লিখেছেন- হারুনূর রশীদ, লণ্ডন শনিবার ২৫এপ্রিল ২০২০সাল