শামসুল হোসেন চৌধুরী শাম্মী, সুশিক্ষিত, খুবই মেধাবী আর নিরীহ গোত্রের খাঁটী ভদ্রলোক। কোন দিন লিখা-লিখিতে আসতে চাননি। জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন ব্যবসা নিয়ে। আমদানী-রপ্তানী ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘকাল। তার সাথে চেনা-পরিচয় সুদীর্ঘকালের। তিনি নিজেকে গড়ে তুলতে গিয়ে ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে পছন্দ করেন ঢাকা-চট্টগ্রামকে। আমরা একই শহরে বড় হওয়া মানুষ। তাদের বাসা ছিল আমাদের যৌবনের প্রগতিশীল রাজনীতির আঁতুরঘর। চাকুরীসূত্রে তাদের বাবা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত একজন ডাকসাইটে পুলিশকর্মকর্তা। স্বাভাবিক কারণেই খুব গম্ভীর স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। আমাকে বহুদিন ডেকে নিয়ে বুঝিয়েছেন আর জানতে চেয়েছেন আমাদের মূল রাজনীতিটা কি? কোনদিনই তার মনমত করে বুঝাতে পারিনি। বলতে পারি আমি শামসুল হোসেনের বাবার খুব কাছের মানুষ না হলেও প্রিয়পাত্র ছিলাম। সে সুবাদে তাদের সকলকে চেনার ও জানার সুযোগ হয়েছে আমার। শামসুল হোসেনের বড়ভাই প্যারিস প্রবাসী নুরুল হোসেন চৌধুরী বয়সে আমার বড় কিন্তু একসাথে আমরা একই রাজনৈতিক অঙ্গনে হেটেছি দীর্ঘকাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে দেশে ঢুকে আমি এই নুরুল হোসেনের বদান্যতায় তাদের ভাদগাঁওয়ের বাড়ীতে আশ্রয় পেয়েছিলাম।
এতোকিছু বলার উদ্দেশ্য হলো, এই শামসুল হোসেন চৌধুরীকে আমি চিনি আজ কমকরে হলেও ৫০ বছর ধরে। হয়তোবা আরো বেশী হতে পারে। এতো দীর্ঘ সময়ের পরিচয় কিন্তু কখনও তাকে লিখক হিসেবে কোথায়ও পাওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। নিজেকে গোটিয়ে রাখার স্পৃহা যে অদম্য শুধু তাই নয়, এ কাজের খুবই দক্ষ নাবিক তিনি।
ফেইচবুক চালুর পর ধীরে ধীরে তাকে একজন মেধাবী লেখক হিসেবে অনুভব করতে শুরু করি। আর তাই, তার জীবনের প্রথম এই লিখাটি এখানে পত্রস্ত করার সুযোগ হাতছাড়া করার মত ভুল আমি করতে চাইনা। -সম্পাদক
-শামসুল হোসেন চৌধুরী শাম্মী
সেদিন ফেইসবুকে দেখিলাম বন্ধুবর রুনু হালদার রাঙ্গামাটির বনে “ বনভোজনে গিয়াছে এবং বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় বসন্ত বাতাসে বসিয়া আহার করিতেছে আর তার সংঙ্গি সাথী ও সাথীনীরা পরম আদরে তাহাকে পরিবেশন করিতেছে। ইহা দেখিয়া আমার যে ঈর্ষা হইল তাহা নহে আবার কিছু হইলও বটে। কারন বনে যাইয়া আহার বা সত্যিকার বনে, বনভোজন এর নির্মল আনন্দ নেয়ার সুযোগ আমার নাই । তবে আজ বনে না গিয়া আপন গৃহে একটি বনভোজনের আবহ সৃষ্টি হইল সে কথাই বলিতে বসিয়াছি।
রন্ধন কর্ম করিবার মত জ্ঞানী বা ইচ্ছুক এমন কেউ কয়েকদিন যাবত আমার গৃহে নাই। ছোট বোনটি সামাজিক কর্মে আরেক বোনের বাসায় নাইওর গিয়াছে, এ সুযোগে গৃহ কর্মীরাও অঘোষিত ছুটি কাটাইতেছে। এদিকে ফ্রিজের প্রস্তুতকৃত আহার্য নি:শ্বেষ হইয়াছে। আমার সংসারে কলেজ গামী এক ভাগিনা ও এক ভাতিজা রহিয়াছেন । দেখিলাম তাহারা উৎকন্ঠাহীন নির্বিকার হাল্কা কাঁথা লেপন করিয়া দুই ঘরে দুইজন বসন্ত নিদ্রা উপভোগ করিতেছেন। আমার অভিভাবক সত্বা জাগিয়া উঠিল হাঁক দিয়া তাদের ঘুম ভাঙ্গাইলাম এবং এহেন অবস্থায় কি করিয়া চলিতে হয় সে ব্যাপারে নাতী দীর্ঘ হিতোপদেশ দিলাম, তাহারা এ্যঁ উ হ্যঁ না এর বেশী কিছু কহিল না। আমি মহিলা বিহীন সংসারে কি প্রকারে খাইয়া বাচিতে হয় এই জ্ঞ্যান তাহাদের হাতে কলমে দেওয়ার মানষে রান্না আয়োজন করিতে মনস্ত করিলাম ও তাহাদের সহযোগিতা চাহিলাম, তাহারা রাজী হইল।
তাহারা রাজী হওয়ায় খুশী হইলাম উৎসাহের সহিত রন্ধন সামগ্রী কিনিতে নীচে নামিলাম গৃহের সম্মুখদিয়া ফেরিওয়ালাদের যাতায়ত অহরাত্র তাহাদের নিকট হইতে একটি মুরগী ও একটি তাল বেগুন সংগ্রহ করিলাম।
বেগুন কাটিতে সময় ব্যায় হয়না এবং খুব সহজেই
কাটা তথা ভাজি করা যায়। গোল বাধিল মুরগীকে লইয়া, জীবনে বহু মুরগী খাইয়াছি ও খাইয়া চলিয়াছি বিবাহ লগ্নে আস্ত মুরগীও বাদ যায় নাই
কিন্তু কোন দিন তাহা কাটিয়া দেখি নাই।
আমার ইতস্তত ভাব দেখিয়া ভাতিজা কহিল মুরগী এইদিক দিয়া কাটিতে হয়, সে গলার দিক নির্দেশ করিল ভাগিনা কহিল মুরগীর রান আগে ছাড়াইতে হয়। ( রান তার খুব পছন্দ আমি জানি )। আমি গাম্ভীর্যের সাথে কহিলাম প্রয়োজন অনুযায়ী অনেক ভাবেই কাটা হয় এবং কালক্ষেপন
না করিয়া কাটাকাটিতে পারদর্শি ভাব বজায়
রাখিয়া বটি চালাইলাম, তাহতে মুরগীর মত মুরগী কাটা হইল কিনা
জানিনা তবে মুরগীটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইল । এ পর্যায়ে মশলা যোগার করিতে গিয়া মস্তিস্ক ক্রমেই উষ্ণ হইতে লাগিল,
পেয়াজ মহোদয় নিজে মরিবার আগে ক্ষনিক কাদাইয়া লইলেন। আদাকে কিছুতেই বাগে আনা যাইতেছিল না, আবার কি কি মশলা লাগিবে এবং তার পরিমান কি হইবে, এসব চিন্তায় ভিতরে ভিতরে গলদঘর্ম হইতেছি আর মনে মনে রান্নার নিকুচি করিয়া চলিয়াছি , কারন আমার পাশ্বে ভাতিজা ও ভাগিনা সাহার্যার্থে দন্ডায়োমান। যদি ব্যার্থ হই সে লজ্জা রাখিব কোথায়?
আমি বৃহত্তরো সিলেটের মানুষ সংগত কারনেই অনেক সিলেটি বন্ধু আমার রহিয়াছেন যাহারা ওতোপ্রত ভাবে ইউরোপ, আমেরিকার সহিত সম্পৃক্ত। মৌলবীবাজারে আহাদের জুয়লারি দোকানে এই সকল বন্ধুদের আড্ডা জমে শুক্রবার ব্যাতিরেকে রোজই সকাল বিকাল। আমি ঢাকা হইতে প্রায়োশ যাই এবং পারত পক্ষে সে আড্ডা মিস করিনা। সেমত এক আড্ডায় বন্ধু নূরু ( কানাডা প্রবাসী) কথা প্রসংঙ্গে বলিয়াছিল- “জানেন নাকি কানাডাতে আজকাল কোন কোন রেস্টুরেন্টে চিকেন অর্ডার করলে তাহারা জানতে চায় চাইনিজ চিকেন না সিলেটি ভূনা? “কথাটা শুনিয়া প্রীত বোধ করিয়াছি
যদিও বাংলাদেশে এ নামটি কোথাও শুনি নাই, রেস্টুরেন্টের কোন ম্যানুতেও দেখি নাই। তবে আমাদের জন্য ইহা একটি চমকপ্রদ বিষয় বটে, যদি কেএফসির মত সিলেটি ভূনা পৃথিবী জয় করে তা বিষদ আনন্দের।
কিন্তু এই কথা এইখানে বলিবার নহে। তবু বলিলাম কারন তৎসময় আমার, কথাটি মনে পড়িল এবং আমিও ভাবিলাম সিলেটি ভূনা করিয়া দেখিনা কেন।
কিন্তু তাহা কেমন করিয়া? ইউ টিউব খুলিয়া বসিলে হইত কিন্তু তাহাতে আমার পারদর্শিতা অর্থাৎ ভাতিজাদের যে উপদেশ আমি দিয়াছি তাহা প্রশ্ন বোধক হইয়া যাইত। আমি তাই স্মৃতির স্মরনাপন্ন
হইলাম। স্মৃতিকে শানানোর চেষ্টা করিলাম, মা রাধিতেন পাশ্বে বসিয়া দেখিতাম সেই সব কথাও স্মরন করিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু স্মৃতি খুজিতে গিয়া নতুন সমস্যা দেখাদিল। স্মৃতির সাথে ট্রিতিও
আসিয়া পড়ে কারন আরোও অনেক কথা মনে পড়িতে লাগিল। একটি প্রয়োজনীয় কাগজ খুজিতে যাইয়া যেমন অনেক কাগজ ঘাটাইতে হয় ইহা সেই রকম কিছু যাহা এই খানে প্রাসংঙ্গিক নয়। তাই সে পথে আর আগাইলাম না। কার্যে মন দিলাম।
মোদ্দা কথা, নুতন পুরাতন স্মৃতি ও আপন পরিমিতি বোধ সহযোগে রন্ধন ক্রিয়া শুরু করিলাম। তার আগে হিন্দুদের কোন “রন্ধন দেবী” আছেন কি না খুজিলাম কারন তাহদেরতো সর্ব বিষয়ের দেব
দেবী থাকে, থাকিলে তাহাকে স্মরন করিয়া লইতাম। কিন্তু না পাইলাম না অগত্যা দ্রব্যগুন ভরষা করিয়া আমার বা আমাদের রন্ধন কার্য শুরু হইল।
শুক্রবার দুপুর চুলায় গ্যাসের চাপ নাই মঙ্গল প্রদ্বীপের ন্যায় হেলিয়া দুলিয়া আশানীয়া কথা শুনাইতেছে বটে কিন্তু কার্য সিদ্ধ হইতেছেনা অন্যদিকে অন্ত্রের আগুন ক্রমেই উর্ধমুখী হইতেছে। এমতবস্থায় রান্না শুরু হইল ধীরলয়ে আগুন চলিল আর আমিও নাড়িয়া চলিলাম ।
ভাতিজা কহিল ক’খানা আলু দেই ?
আমি কহিলাম না তাহাতে “ভূনা”র মর্যাদা হানী হয়, ভাগিনা কহিল আরেকটু তৈল প্রয়োগ দরকার মনে হয়।
কহিলাম তৈল স্বাদ বৃদ্ধি করে বটে কিন্তু সাস্থ্যের জন্য হানী কর। সুতরাং পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য নাড়াচারা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প রহিল না। আমি নাড়িয়া চলিলাম।
বিকাল হইল আমি রান্না শেষের ঘোষনা দিলাম ও চীফ শেফের মত রন্ধনশালা হইতে নিস্ক্রান্ত হইলাম।
যুবকদ্বয় পরিবেশন করিল। সকলে আহারে বসিলাম, দেখিলাম মুরগীটির হাড় গোর আলাদা হইয়া পোড়া মাংস সমন্বয়ে এক জটিল শিল্প সৃষ্টি করিয়াছে। শুস্ক মরুভূমে ক্যাকটাস এর মত অনেকটা।
ভাতিজা দ্বয় পেয়াজ, কাচামরিচ, টমেটো কাটিয়া আনিল – আমরা খাওয়া শুরু করিলাম, দেখিলাম দেখিতে অসুন্দর হইলেও স্বাদ খারাপ হয়নি, ভাবিলাম কর্কশ ক্যাকটাসেও তো ফুল ফোটে।
ক্ষুধার্ত থাকার জন্য কিনা জানিনা আমরা তিন জনেই প্রচুর খাইলাম। এই ভাবে আমাদের দুই প্রজন্ম মিলে গৃহ অভ্যন্তরে বন ভোজন না হোক বুনোভোজন অনুষ্ঠিত হইল।
সময়টা কষ্টে কাটিলেও শেষটায় আনন্দ হইল।
তাহাদের শুধাইলাম কেমন হইল বাবা সকল?
ভাতিজা কহিল – “খুব বালা অইছে চাচা”
ভাগিনা কহিল – “কাবাব অর লাখান অইছে, খুব মজা অইছে মামা”
আমি কহিলাম – সাধু, সাধু!