হারুনূর রশীদ
ছোট্ট একটি খবর। খবরের মালিক চরমোনাই এর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। খবরটি প্রকাশ করেছে ইত্তেফাক আজ ১৭ই এপ্রিল। খবরের বিষয়বস্তু সুপ্রিম কোর্টের সেই ভাস্কর্য।
গ্রিক পুরাকাহিনী (মাইথোলজি) অনুযায়ী দেবী থেমিস ছিলেন গ্রীকদের ন্যায়পরায়ণতার দেবী। যার এক হাতে রয়েছে দাড়িপাল্লা আর অন্যহাতে খোলা তলোয়ার। দু’চোখ থাকে কালো কাপড়ে বাধা। এই চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকার কারণ, এতে বোঝানো হয় যে , আইন অন্ধ। চোখে দেখলে পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি হতে পারে, তাই আইনের চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে, যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হয় বিচার। তাই চোখে কালো কাপড়, আর অন্য হাতে খোলা তলোয়ার থাকার অর্থ হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে আইন শক্তি প্রয়োগও করতে পারে। আমরা সকলেই বুঝি দাড়িপাল্লা হলো ন্যায়বিচারের প্রতীক। এতে বোঝানো হয়, আইন সবাইকে সমানভাবে বিচার করবে।
বিশ্বে, গ্রন্থভুক্ত বা সংকেত লিপিবদ্ধ করা(কোডিফাইড) আইনের গোড়াপত্তন ঘটে রোমান আমলেই প্রথম। এক কথায় পুস্তকাকারে আইনের লিখিত রূপের সৃষ্টি রোমান আমলে। রোমান সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রভূত উন্নতি ঘটে বিশ্বের আইনশাস্ত্রের। মহান রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান এবং কনস্টানটাইনের ভূমিকা রোমান ইতিহাস বা আইন পড়ুয়া কে-না জানে। এক্ষেত্রে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। রোমানদের কাছে ‘লেডি জাস্টিস’ বিবেচিত হতেন ন্যায়পরায়ণতার দেবী হিসেবে। আর এই লেডি জাস্টিসই ছিলেন গ্রিক পুরাণের (মিথলজির) ‘দেবী থেমিস’।
ভাস্কর্য আর মূর্তিপূজার মধ্যে যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে তা সম্ভবত আমাদের পীর, মোল্লা কিংবা মৌলভীগন সহজে বুঝতে পারেন না বা মস্তিষ্কে ধারণ করা সম্ভব হয়না। অথবা তারা বুঝেও না বুঝার ভান করেন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। বিষয়টি সারা বাংলাদেশের মানুষই বুঝে যে আমাদের বিচারালয়ের ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক দেবী থেমিসের মূর্তিতে কেউ কোনদিনই ফুল, বেলপাতা কিংবা তুলসী পাতা নিবেদন করে পূজা করতে যাবে না যে তা মূর্তিপূজা হিসেবে বিবেচিত হবে! এটা শুধুই একটা ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সৌন্দর্য চর্চ্চা ও নান্দনিকতা তার বাড়তি পাওয়া।
এ নমুনার ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কিছু ধান্ধাবাজ ধর্মব্যবসায়ীদের কূপমন্ডুকের নসিহত আজ নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ চলে আসা এসব ধান্ধাবাজদের দুষ্ট কূটনীতির ছলে প্রধানমন্ত্রীকে হাতে রেখে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির পীর চরমোনাই সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বামপন্থি নেতা ও মন্ত্রীরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। কথাটা শুনে না হেসে পারি না। কে কাকে কি বলছে!
আজকে যারা এই ভাস্কর্য সরানোর দাবী করছেন যদি প্রশ্ন করি এই বাংলাদেশ যখন ভুমিষ্ট হয় তখন আপনারা কোথায় ছিলেন এবং আপনারা বা আপনাদের পূর্বপুরুষদের সেইসময় ভূমিকা কি ছিল? উত্তর দেয়ার নৈতিক বা মানবিক শক্তিতো কারো নেই আমরা খুব ভাল করেই জানি। আপনারা এবং আপনাদের পূর্বজনেরা সকলেই সে সময় শেয়ালের মত একসুরে গান গেয়েছিলেন-ইয়ে হামারা পাকিস্তান ইয়ে হামারা ওতন হ্যায়। শুধু কি তাই, আপনাদের পীর-মাশায়েকরা আমাদের জাতির ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে কোথায় সাধারণ মানুষের বিপদের বন্ধু হয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে চলবেন, তাতো করেননি উপরন্তু কাপুরুষ ধান্ধাবাজের মত পাক-হায়নাদের দ্বারা আমাদের মা-বোনের বেইজ্জতিকে ‘মাল-ই-গনিমাত’ এর উপর এ ধর্ষণ জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এতো সহজে আমরা তা ভুলে যাবো- একমাত্র আপনাদের মত ভন্ড স্বার্থান্বেষী, মৌলবাদী জঙ্গি আস্তানার মালিকরাই এমন মনে করেত পারেন! সারা বাঙ্গালী জাতি পাকহায়েনাদের সাথে আপনাদের সেদিনের ভয়ঙ্কর নরপিশাচের ভূমিকার কথা কি করে ভুলবে। আপনাদের তৈয়ারী রাজাকার-আলবদরদের সেদিনের ইতিহাস সৃষ্টিকারী গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, অগ্নিসংযোগ আর আমাদের মা-বোনদের বেইজ্জতির কাহিনী আমরা কি করে ভুলবো?
আজ কোন সাহসে, আমরা যারা যুদ্ধ করে দেশ বানিয়েছি সেই আমাদের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা কারণ দয়া করে, প্রানে রক্ষা করে আপনাদের দেশে থাকার সুযোগ দিয়েছি। তাতো নয় বরং বেহায়া, বেশরম, বেইমান মুখপোড়াদের মত দেশ সাজানোর কাজে মাথা গলাতে চান! আপনারা কি করে ভুলে যান, এই সেদিনও শাহবাগের উত্তাল দিনগুলোতে ‘শুয়োরের সাথে সহবাসের ফতোয়া’ দিয়েছিলেন। এই সেদিনও আমরা হবো তালেবান বাংলা হবে আফগান বলে শ্লোগান দিয়েছো।আপনাদের ভন্ডামী আর ফতোয়াবাজীকে স্থায়ীরূপ দিতে সুচতুরভাবে দেশের বেশিরভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে উত্তেজিত করার কূটকৌশল নিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর উদ্দেশ্যে দুনিয়াব্যাপী স্বীকৃত একটি মহাপবিত্র ভাস্কর্যকে নাস্তিকতাবাদের বদনাম দেবার সাহস করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি দৃঢ়মনের সকল মহলকে হলফ করে বলতে পারি এই দাবিতে বর্ণচোরেরা সফলতা পেলে অবাক করা হবে না যদি এই দুষ্টমতির দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাজেয় বাংলা বা শহীদ মিনার বা সাভারের স্মৃতিসৌধ সরিয়ে নেয়ার দাবি তুলে। ওরা তুলবেই। সুযোগ পেলে, প্রতি বছর ফুলেল শুভেচ্ছা সহকারে শহীদ স্মরণকেও তারা পূজা হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে! এটাই প্রমাণিত অতীত।
আমাদের এই স্বাধীনতা বিরুধী অনেকেরই প্রিয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের আদালতেও যে দেবী থেমিসের এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তা সম্ভবত জানা নেই তাদের। যেমন ব্যবহৃত হয়ে থাকে মিশর, তুরস্ক, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অপরাপর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রেও।
ধর্মের নামধারী এই সব সংগঠনগুলোর অপতৎপরতা এখন হুমকির রূপ নিয়েছে। উপরন্তু সবাই দেখেছেন সরকারি দলের একাধিক কর্তাব্যক্তিও হাটহাজারিতে ছুটে গেছেন শফি হুজুরকে শান্ত রাখতে। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে রেলের জমি লিজ দেয়া শুরু করে অনেক উদ্যোগই নিয়েছেন তারা। কিন্তু তাদের এই নতজানু উদার নীতির কোনটাই তেমন কোনো কাজেই আসেনি। এত সব উপহার পেয়ে হুজুর শান্ত তো হনই নি, বরং উত্তরোত্তর বেড়ে গেছে তাদের দাবি দাওয়া। আর বহু দাবী সহজেই মেনে নেয়া হয়েছে।
গত বছর তারা হঠাৎই দাবি তোলে পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু আর নাস্তিক লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার। সে সময় এটা নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সমালোচনা করাও হয়েছিলো। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখা গেলো এ বছর পাঠ্যপুস্তক থেকে তাদের দাবি মেনে প্রায় ৩৭ টি মানসম্পন্ন লেখা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু যোগ করা হয়নি জঙ্গিবাদ বিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নতুন কোন লেখা।
হেফাজতের দাবি-দাওয়ার বহর দেখে সবশেষে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের মধ্যেও ক্রমশ দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এরই প্রতিফলন দেখা যায় সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্যে। শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নগরীর টিআইসি মিলনায়তনে তীর্যক নাট্যদলের একুশে স্মরণে ‘নাট্যভাষা বাংলা আমার’ শীর্ষক পাঁচ দিনের নাট্যায়োজনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন, ‘যে পরিবর্তনকে হেফাজত বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানায় সেই পরিবর্তন আমার না পড়লেও চলে। তারা হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক প্রতীক বিবেচিত ভাস্কর্যটি তুলে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ক’দিন পর এ মঞ্চে নাটক করতে পারবেন না, গান গাইতে পারবেন না, আবৃত্তি করতে পারবেন না। এখানে তারা সমাবেশ করবে। হেফাজত এমনভাবে বলছে মনে হয় এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নয়, যেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ।’
স্বাধীনতার পর থেকেই সবকিছুতেই ধর্মীয় অনুভূতির ধোঁয়া তোলে এবং সাধারণ ধর্মপ্রান নিরীহ মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিতে সুরসুরি দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ আদায় এবং নিজেদের কলুষিত অতীতকে ভুলিয়ে রাখার প্রবনতা এখন বিষময় হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই ক্রমশই বেপারোয়া হয়ে উঠছে ধর্মের নামধারী উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো। এই হেফাজতে ইসলামের সাথে জড়িত সেই ব্যক্তিরাই যারা একদিন ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ শ্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলেছিলো এ দেশের আকাশ বাতাস। আজ তারাই আবার আবির্ভূত হয়েছে নতুনরূপে। আর দিন দিন ক্রমশঃ ভয়াবহ এক দৈত্যশক্তিতে পরিণত হচ্ছে এরা। একদিন থলের এই বিষধর সাপটি বেরিয়ে আসবেই। জড়ি বা মন্ত্র জানা না থাকলে ছোবল মারবেই, তা বলে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। অতএব সাধু সাবধান!
লন্ডন, সোমবার ৩ বৈশাখ ১৪২৪