প্রনীত রঞ্জন দেবরায়, কমলগঞ্জ।। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে স্থানীয় এক আওয়ামীলীগের এক নেতাকে রাতে বাড়ি ফেরার পথে সংঘবন্ধ দুর্বৃত্ত চক্র হত্যা করেছে। গত রোববার, ৫ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ১০টায় উপজেলার ১নং রহিমপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের ধলাই নদী সংলগ্ন খেলার মাঠ এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত ব্যক্তি রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক আলতা মিয়া(৫৫)। তিনি রহিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সিনিয়র সদস্য ছিলেন।
সোমবার (৬ এপ্রিল) সকালে সরেজমিন গেলে নিহতের পরিবার সদস্য ও গ্রামবাসীরা জানান, গত রোববার রাত সাড়ে ১০টায় আলতা মিয়া মির্তিংগা চা বাগান থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার বাড়ির অদূরে ধলাই নদীর তীরবর্তী ফুটবল মাঠ অতিক্রমকালে একদল দৃর্বৃত্ত অতর্কিতভাবে তাকে কুপিয়ে গুরুতর অবস্থায় ফেলে যায়। গ্রামবাসীরা তাকে উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল হয়ে রাতেই সিলেট এম, এ, জি, ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর তার মৃত্যু হয়।
নিহত আলতা মিয়ার সন্তানরা বলেন, তাদের বাবার সাথে আওয়ামীলীগের একটি অংশের বিরোধ ছিল। তাছাড়া ধলাই নদীর বালু ঘাটের ইজারা নিয়ে ইজারাদারের সাথে একটি পক্ষের মামলা ছিল। সে মামলায় এ গ্রামের ফুল মিয়ার ছেলে কুখ্যাত ডাকাত ইব্রাহীম মিয়া আসামী ছিলেন। ডাকাত ইব্রাহীম মনে করতো তাদের বাবা (আলতা মিয়া) এ মামলায় তার নাম ঢুকিয়েছেন। এ নিয়ে ইব্রাহীম ও তার অনুসারীরা বেশ কিছু দিন ধরে তাদের বাবা (আলাতা মিয়াকে) হুমকি দিচ্ছিল। তারা মনে করেন ইব্রাহীমের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্রই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তারা আরও বলেন, মৃত্যুর আগে তাদের বাবা যারা তাকে কুপিয়েছে তাদের নাম প্রকাশ করে গেছেন। তারা হলো একই গ্রামের ফুল মিয়ার ছেলে ইব্রাহীম মিয়ার নেতৃত্বে ছমদু মিয়ার ছেলে খুরশেদ মিয়া, রোশন মিয়ার ছেলে জামাল মিয়া, জয়নাল মৃধার ছেলে আফজাল মৃধা ও মাহমুদ মিয়ার ছেলে বদরুল মিয়া।
গ্রামবাসীরা জানান, কয়েক বছর আগে এ গ্রামে আরও একটি খুন হয়েছিল। সে ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিলেন আলতা মিয়া। সে হত্যকান্ডের এক আসামী পালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যায়। সেখান থেকে টাকা সহায়তা দিয়ে ইব্রাহীম ডাকাত ও তার সহযোগীদের দিয়ে রোববার রাতে আলতা মিয়াকে হত্যা করেছে বলে গ্রামবাসীরা মনে করেন।
১নং রহিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ বদরুল বলেন, আওয়ামীলীগের একজন নিবেদিত সদস্য ছিলেন আলতা মিয়া। তিনিও মনে করেন ডাকাত ইব্রাহীমের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ চক্র এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সিলেটে আলতা মিয়ার ময়না তদন্ত শেষে লাশ বিকেলে রামচন্দ্রপুর গ্রামে আসবে।
কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, পুলিশ বিষয়টি দেখছে। নিহতের পরিবার থেকে মামলা দিলে তার আলোকে পরবর্তী আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সোমবার (৬ এপ্রিল) থেকে প্রতিদিন বিকেল ৫টার পর শুধুমাত্র ফার্মেসী ব্যতিত সকল দোকানপাঠ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। নিত্যপণ্যের এসব বাজার ও দোকান এখন খোলা থাকবে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। সোমবার (৬ এপ্রিল) সকালে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশেকুল হক স্বাক্ষরিত এক জরুরী বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও সামাজিক দূরত্ব ফলপ্রসূভাবে নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কমলগঞ্জ উপজেলার শুধুমাত্র কাঁচাবাজার, ফলের দোকান (পচনশীল), খাবারের দোকান, অনুমোদিত কৃষিপণ্য (সার, বীজ, কীটনাশক) ও কৃষি যন্ত্রপাতির দোকান/ডিলার, গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান এবং বিকাশের অনুমোদিত এজেন্টের দোকান প্রতিদিন সকাল ৬ টা হতে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে বিকেল ৫টার পর শুধুমাত্র ওষুধের দোকান, হাসপাতাল ও জরুরী সেবা খোলা থাকবে।
সম্প্রতি কমলগঞ্জের পার্শ্ববর্তী রাজনগর উপজেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। এতে নতুন করে কমলগঞ্জ উপজেলায়ও আতঙ্ক শুরু হয়। এসব কারণে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন এক লিখিত নির্দেশনা জারি করেন।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক জানান, করোনাভাইরাসের প্রতিরোধ ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সারা জেলার মতো কমলগঞ্জ উপজেলায় এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্যকারীদের বিরেুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
করোনা ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার উত্তর তিলকপুর গ্রামবাসী ও যুবসমাজের উদ্যোগে প্রশাসন ছাড়াই সড়ক বন্ধ করে লকডাউন করা হয়েছে। সোমবার থেকে গ্রামটির যুবসমাজ ও বাসিন্দারা করোনা প্রতিরোধে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না বলে জানা যায়।
কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন এর মঙ্গলপুর, চিৎলীয়া ও জাঙ্গালীয়া সড়কের উত্তর তিলকপুর গ্রামে প্রবেশ পথে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী ফটক। কেউ যাতে গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে কিংবা গ্রামের কেউ যাতে অযথা বাহিরে বের হতে না পারে, সে জন্য গ্রামের মূল ফটকে বসানো হয়েছে পাহারা। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সবধরনের খেলাধুলা ও সামাজিক অনুষ্ঠান।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রুপেন্দ্র কুমার সিংহ বলেন, উত্তর তিলকপুরের এ গ্রামে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার বাস করে। করোনা প্রতিরোধে এ গ্রামের সবাই স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। এছাড়া জরুরী কাজে বের হওয়া ও গ্রামে প্রবেশ করা মানুষদের শরীরে ছিটানো হচ্ছে জীবাণুনাশক। এই সময়ে কমলগঞ্জ উপজেলার প্রত্যেকটি স্থানেই নিজ উদ্যেগে লক ডাউনে থাকার প্রয়োজন।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর সানফ্লাওয়ার যুব সংঘের উদ্যোগে কর্মহীন অসহায় দু:স্থদের মাঝে বিতরণের জন্য সোমবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে শমশেরনগর ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ এর নিকট ৫০ হাজার টাকা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক (তদন্ত) অরুপ কুমার চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা নির্মল কুমার দাসসহ সানফ্লাওয়ার যুব সংঘের উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাবৃন্দ। ১০০ টি কর্মহীন অসহায় দু:স্থ পরিবারের মাঝে এই খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হবে। পরিবার প্রতি ৫ কেজি চাল, ১ কেজি মসুরী ডাল, ১ কেজি আলু, ১ কেজি পিঁয়াজ, আধা লিটার তেল, আধা কেজি লবণ ১টি সাবান রয়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সারাদেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ ও লোক সমাগম নিয়ন্ত্রণ করায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে খেটে খাওয়া মানুষজন, দিন মজুর ও অসহায় দরিদ্র লোকজন ঘরের বাহিরে বের হতে না পারায় দুর্ভোগের মাঝে পড়েছেন। বিক্ষিপ্তভাবে সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি উদ্যোগে অসহায় দরিদ্র মানুষজনকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। এর মধ্যে বেশি অসহায় ছিলেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তারা লজ্জায় ঘরের বাহিরে এসে লাইন ধরে খাদ্য সামগ্রী নিতে পারছেন না। আবার কারো কাছে সাহায্যর কথা মুখ খুলে বলতেও পারছেন না। ব্যতক্রমী উদ্যোগ গ্রহন করে কমলগঞ্জের শমশেরনগর ইউনিয়নের বাজার ওয়ার্ডের সদস্য এমনি ১০০ মধ্যবিত্ত পরিবারের তালিকা করে বাসায় বাসায় গিয়ে রাতে খাদ্য সামগ্রী পৌছে দিলেন।
শমশেরনগর ইউপি সদস্য আজিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের সময় গত ১ এপ্রিল থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি তার সহযোগী লিয়াকত আলী, মোকরামিন চৌধুরী, তামজিদ রাজু, তার দুই ছেলেসহ কয়েকজনকে নিয়ে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ২১৫ জন দরিদ্র অসহায়দের খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছেন। এসময় তিনি উপলব্দি করেছেন দুর্ভোগের শিকার হয়েও কোন মধ্যবিত্ত পরিবার সদস্যরা ঘরের বাহিরে এসে খাদ্য সামগ্রী নিচ্ছেন না। তাই তিনি তার ওয়ার্ডেও অসহায় মধ্যবিত্ত ১০০ পরিবার চিহ্নিত করে রোববার রাতে পরিবার প্রতি ৩ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি লবন ও আধা লিটার ভোজ্য তেল মিলিয়ে প্যাকেট করে রাতেই তাদের বাসায় পৌছে দিয়েছেন। প্রয়োজনে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্ধু বান্ধবদের সহায়তা নিয়ে দরিদ্র মানুষজনের সাথে সাথে আরও কিছু সংখ্যক মধ্যবিত্ত পরিবারে খাদ্য সামগ্রী পৌছে দিবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যবিত্ত পরিবারের দুইজন সদস্য এ প্রতিনিধিকে বলেন, বাহিরে বের হয়ে কোন কাজ করতেও পারছেন না। আবার ঘরে খাবারও নাই। এমন সময় ইউপি সদস্যেও এ উদ্যোগ তাদের জন্য বেশ বড় সহায়তা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
শমশেরনগর ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ বলেন, তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে রাতে বাসায় বাসায় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ মুখ খুলে সাহায্যের কথা না বললেও তিনি খোঁজ খবর নিয়ে মধ্যবিত্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আরো বলেন, যদি কোন মধ্যবিত্ত বা নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবার খাদ্য সংকট মনে করে তাহলে সরাসরি তাকে ফোন করলেই তিনি বাসায় খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়ে দিবেন। তিনি এমন মহাদুর্যোগের সময় সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।