মুক্তকথা প্রবন্ধ।। এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হয়ে সাংবাদিকতার প্রতি এক দূর্দমনীয় টান অনুভব করলাম। কেনো এই টান মনে কাজ করতো তা, সে সময় বিষয়টি কষ্মিনকালেও ভেবে দেখবো এমন চিন্তায়ই আসেনি। আজকের এই সময়ে সুদূর ফেলে আসা অতীতের সে দিনের চিন্তা চেতনার মূলে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। তবে একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়, যা দিয়ে আমার মনোজগতের গড়ে উঠাকে কিছুটা জানতে পারা যাবে। আমার বাবা প্রয়াত আমীর আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ওয়াছিল খুবই সংস্কৃত মনের মানুষ ছিলেন। বাবা বাড়ীতে দাওয়ায় বসে ‘হালতুন্নবী’ পুঁথি সুর করে পড়তেন। আমি নিজে তার কাছে বসে বহুদিন শুনেছি। আমার মা’ও সারাদিন ঘরে কাজের সাথে সাথে কুনকুনিয়ে রাধারমণের গানের সুর আওরাতেন। বাবা ও মা’য়ের এ দুটু অভ্যেস ছিল। মা গান জানতেন না। কিন্তু আমার নিজের দেখা ও শুনা, মা- রাধারণ, আব্বাস উদ্দীন, নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্র নাথ এসব খ্যাতিমান মানুষের বিভিন্ন গানের কলি সুর দিয়ে নিচু সুরে গাইতেন। বলতে গেলে সারা দিনই। সকল কাজেই তাকে এভাবে কুনকুনিয়ে গান গাইতে দেখতাম। বাবাও সপ্তাহে কমপক্ষে দু’তিন দিন ঘরের বারান্দা যা’কে অনেকেই দাওয়া বলে, সেই দাওয়ায় বসে সুর দিয়ে পুঁথি পড়তেন। ঘরের ভেতরে বসে মা খুব মনোযোগ দিয়ে বাবার পুঁথি পড়া শুনতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাবার সেই দুইখানা পুঁথি আমাদের ঘরে ছিল। আমার ধারণা ওখান থেকেই আমার এ পথে গড়ে উঠা।
স্কুল জীবন থেকেই লেখা-পড়ার চেয়ে নাটক, যাত্রা, গান-বাজনা, খেলা-ধূলা অর্থাৎ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম বেশী। ‘কাব স্কাউট’ থেকে শুরু করে ‘বয়েজ স্কাউট’ ও ‘রবার স্কাউট এ অংশ নিয়েছি। এরই সূত্র ধরে বহু পরে ‘উডব্যাজ’ প্রাপ্ত হই। স্কুলের বার্ষিক খেলায় কিংবা বাৎসরিক নাটকে আমার অংশ থাকতোই। সে সময় প্রতি বছরই আমাদের শহরে যাত্রা হতো। প্রতিটি স্কুলে এবং কলেজে বাৎসরিক খেলা-ধূলা, মিলাদ-পূঁজা ও নাটক মঞ্চায়ন হতো। শহরে বেশ কয়েকটি সংঘ সমিতি ছিল যারা প্রতি বছর নাট্যানুষ্ঠান করতো। ওগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতাম। বিশেষ করে দূর্গাপূঁজার সময় আমাদের আশ-পাশের সবক’টি চা-বাগানে চিরাচরিত প্রথানুসারে যাত্রাপালা মহাধুমধামে চলতো। প্রাক্তন সিলেট জেলার অধিকাংশ চা-বাগান মৌলভীবাজারে অবস্থিত তাই খুব কম যাত্রাই আমার দেখা থেকে বাদ পড়েছে। এতো যাত্রাপালা দেখেছি যে আজ হিসেব দেয়া মুসকিল। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন তিমির রাতে বন্ধু-বান্ধব মিলে চড়াই-উৎরাই পাহাড়ী পথ ডিঙ্গিয়ে সারা রাতভর লেপ-মোড়া দিয়ে দু’নয়ন মেলে যাত্রাদৃশ্য অবলোকন সে যে অন্য এক আনন্দ। দূর্লভ সে আনন্দ উপভোগের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যাত্রা, নাটক কিংবা সিনেমা বা সবাকচিত্রের মধ্যে ঐতিহাসিক কাহিনী আমার খুবই প্রিয়। খুব জোর দিয়ে বলতে পারি ওখান থেকেই ইতিহাস পাঠের প্রতি ঝোঁকের জন্ম। সম্ভবতঃ ওই ঝোঁক থেকেই জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্তির মাধ্যম হিসেবে সাংবাদিকতার প্রতি আকৃষ্ট হই।
স্কুল জীবন থেকেই কচি-কাঁচার সাথে জড়িত হয়ে পড়ি। পরিচিত হই দাদাভাই রুকনোজ্জামান খান ও কুমিল্লার মোস্তাফা ভাইয়ের সাথে। সেই পরিচয়ই ইত্তেফাকে সাংবাদিকতার সুযোগ করে দেয়। ইত্তেফাকের বদৌলতে সাংবাদিক লেখক সিরাজউদ্দীন হোসেনের সাহচর্য্য কিছুটা পেয়েছিলাম। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক অধ্যাপক আসফউদ্দৌলা রেজাভাইকে পেয়েছি ঘনিষ্ট শিক্ষক হিসেবে। রমেন বাবু বলে সদা হাস্যমুখের এক ভদ্রলোক মফঃস্বল ডেস্কে কাজ করতেন। তারও সাধুসাহচর্য্য পেয়েছি। পরে তিনি গণকণ্ঠে যোগ দিয়েছিলেন। আই এ পাশ করার পর ইত্তেফাকের নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। এর পর একটানা তেইশ বছর ইত্তেফাকের সাথে কাজ করেছি একনিষ্ঠতার সাথে। একই সাথে আমি ‘দি নিউ নিশন’, পূর্বাণী ও রোববার-এর মৌলভীবাজারস্ত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। ইত্তেফাক সংবাদদাতা সমিতির আমি সহসম্পাদক ছিলাম দীর্ঘদিন। বাংলাদেশ সংবাদদাতা সমিতিরও সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম বহু বছর। এই সুবাদে বাংলাদেশের বরেণ্য সাংবাদিকদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। স্বাভাবিক কারণেই ইত্তেফাকের সাংবাদিক প্রায় সকলের সাথেই পরিচিত ছিলাম। তাদের অনেকেই আজ আর এ জগতে নেই। এ সময়ই ফটো সাংবাদিক প্রয়াত রশিদ তালুকদার ভাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার গৌরবের অধিকারী হই। আমিই সর্বপ্রথম মৌলভীবাজারে ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করি এবং পর্যায়ক্রমে সম্পাদক ও সভাপতির দায়ীত্ব পালন করি।
সেই থেকে শুরু করে সুদীর্ঘকালের দেখা-দেখি, খোঁজা-খুঁজি করে দক্ষিন সিলেট তথা মৌলভীবাজারের অতীত রূপ যা কিছু পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট নয়। শুধুই মনে হয়, এ যেনো অন্ধকারে হাটা-হাটি। যে পথে হাটলে খোঁজ পাওয়া যাবে সে পথেরই দিশা জানা নেই। দিশা পেতে গিয়ে যে সব দলিল ও পুস্তক খুঁজে খুঁজে দেখেছি তার মাঝে ৪খানা পুস্তক আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। যেখানে প্রাচীন সিলেটের বিস্তৃত দক্ষিণ অঞ্চল বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা হয়েছে। যদিও সেই বলা কাহিনীগুলোও যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়েছে। তারপরও এ চারখানা পুস্তকই সিলেটের দক্ষিণাঞ্চল বিষয়ে সবেধন নীলমণি। এই পুস্তকগুলোকে অনুসরণ করে এর পরে অনেকেই সিলেট বিষয়ে পুস্তক রচনা করেছেন। সে সব পুস্তকে দক্ষিণ সিলেট বা মৌলভীবাজার বিষয়ে নতুন কোনকিছু তথ্য সন্নিবেশিত হয় নি। একই তথ্যের পূণর্লিখন হয়েছে মাত্র।
একটি বিষয় হলো, যেহেতু এ ভূখণ্ডটি ছিল এবং প্রাচীন জনবসতিরও আভাস পাওয়া যায়, তা’হলে উজ্জ্বল হোক আর কালিমালিপ্ত হোক একটা অতীত তো থাকবেই। যতদূর জানা যায় সকলের আগে খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে শাহজালাল তথা সিলেট নিয়ে মৌলভীবাজারের মোহাম্মদ আহমদ ছোট্ট একটি পুস্তিকা লিখেন। পুস্তকখানা এতই সংক্ষেপ ছিল যে সেখানে মৌলভীবাজার নিয়ে বিস্তারিত কোন কথা নেই। (-চলবে)
হারুনূর রশীদ, এই লিখার মূল তারিখ ১৯৭৯ইং, অনলাইনে লেখা শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর ২০২০সাল।
|