হারুনূর রশীদ।।
খুব উপর তলার নেতা ছিল না। যা ছিল, নিজের নিরীহ গরীব আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে সব সময়ই ব্যস্ত এক মানুষ। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক বাম রাজনীতির সহযোগী ছিল। সহপাঠীদের প্রতি আন্তরিকতা ছিল অনন্য। আকাঙ্ক্ষা ছিল অদম্য। হৃদয়ে উদারতার উচ্চতা কোনদিন পরিমাপের চেষ্টা করিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ গঠনের পর আমার সাথে পরিচয়, জাসদের একজন আন্তরিক সমর্থক হিসেবে। কোন দিনতো জানার চেষ্টা করিনি আর প্রয়োজনও হয়নি যে জানতে চাইবো- কেনো সে জাসদকে সমর্থন করে! সবসময় হাসিমাখা মুখের এমন প্রানখোলা মনের কোন সাথী সহযোগীকে কেউ কি কখনও প্রশ্ন করতে পারে, কেনো এ দল করিস? এভাবে কেউ কোনদিন জানতে চায় না। আমিও কখনো চাইনি!
গ্রামের বাড়ী মৌলভীবাজার শহরের একেবারে উত্তর প্রান্তে কাউয়াদীঘি হাওর সংলগ্ন রসুলপুর গ্রামে। শহরেই আনাগোনা বেশী। ভাই ভাতিজাকে কিভাবে ভাল কাজে লাগানো যেতে পারে এ নিয়েই ব্যস্ত সময় তার কাটতো শহরে। কখনও ট্রেভেলস ব্যবসায়, আবার কখনও থানা আদালতে দৌড়াদৌড়ি, এসবের ফাঁকেও জাসদের কোন কর্মসূচীতে অনুপস্থিত দেখিনি। গণবাহিনীর আরেক ক্যাডার আশি-নব্বই দশকের জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বুড়িকোনা গ্রামের সুলেমান আলীর সাথে ভাব ছিল গলায় গলায়। সিদ্দেক-সুলেমান দু’জনের একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে ভাবাই যেতনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের বিভিন্ন উৎপাত থেকে নিরাপদ থাকতে সুলেমানকে আপন ভাইয়ের মত সহায়তা করেছিল এই সিদ্দেক।
তখন গণবাহিনীর কঠিণ সময় পার করছি আমরা কতিপয়। আমি গণবাহিনীর ছোটখাটো এক ক্যাডার ছিলাম। সাংবাদিকতায় আমার খুব প্রসার ছিল। সেই সুবাদে অনেক যায়গায় হাজিরা দিতে পারতাম। আর ওই সুবাদেই যা হয় আমার অবস্থাও ছিল তেমনি। এবাদুর রহমান উকিল তখন জাসদের সভাপতি। রসুল পুরের মুজিব উকিল আমাদের ঘনিষ্ট সাথী। তার বাড়ীতেই গণবাহিনীর সভার ব্যবস্থা হল। সিদ্দীকদের পাশের বাড়ী। সদর রাস্তাদিয়ে আমাদের চলাচল সম্ভব ছিল না। সময়টি তখন খুবই খারাপ। সময়টা আমাদের রাজনীতির প্রতিকূলে। দুঃসময় যখন আসে সবদিক থেকেই আসে! শহরের বড়হাট এলাকা থেকে রসুলপুর পর্যন্ত বানভাসি। নৌকা ছাড়া আমাদের চলাচলের কোন রাস্তা নেই। বড়হাটের মুকিত(পরলোকগত) একখানা নৌকা সংগ্রহ করে জানালো, সিদ্দীক-সুলেমান আর একখানা নৌকা নিয়ে আমার এক সহপাঠী উলুআইলের মুকিত মিয়ার বাড়ীর কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আমরা সময়মতো পৌছাতে পারবো। এবাদুর রহমানকে সঙ্গে নেয়ার উদ্দেশ্যে খোঁজ করতে গিয়ে তাকে পেলাম না। বুঝতে পারি তিনি পালিয়েছেন। নৌকা নিয়ে আমরা রওয়ান হই। মুকিত মিয়ার বাড়ীর কাছে পৌঁছার আগেই নৌকায় পেয়ে গেলাম সুলেমান ও সিদ্দেককে। তারা জানালো মুজিবুর রহমান বাড়ী থেকে উদাও। তাকে বাড়ীতে পাওয়া যাচ্ছে না। এবাদুর রহমানেরও খোঁজ নেই। অতএব আজ বৈঠক হচ্ছে না। সিদ্দেক সেদিন হাসতে হাসতে বলেছিল- আমাকে বললেন না কেনো, আমি বৈঠকের জন্য নিরাপদ একটি বাড়ীর ব্যবস্থা করতাম। একটা কিছু শক্তভাবে করতে হবে হারুনভাই। এভাবে হবে না। একটা কিছু করুন।
সিদ্দীক আর কোনদিন হাসিমাখা মুখে বলতে আসবে না- “হারুন ভাই একটা কিছু করুন…।” জানতে পারবো না কেনো আমাদের এতো পছন্দ করতো! আজ সোমবার ১২ জুন বিকেল সাড়ে ৬টার সময় লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে চিরনিদ্রার কোলে আশ্রয় নিয়েছে সিদ্দীকুর রহমান সিদ্দেক, (ইন্না…রাজেউন)। মৃত্যুকালে সিদ্দেকের বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।