উড়িষ্যা থেকে আগত উড়িয়া সম্প্রদায়। চা বাগানে বসবাসকারী এই জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পূজা-অর্চনা ইত্যাদি। উড়িয়ারা চৈত্র অমাবস্যায় টানা ১৩ দিনের বিশেষ ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ব্রত উৎসব পালন করে। চা বাগান এলাকায় এটি “ডন্ড” উৎসব নামে পরিচিত। গত ৩১ মার্চ শুক্রবার থেকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা বাগান থেকে এ উৎসব শুরু হয়েছে।
১৩ দিনের উৎসবে যোগদানকারীরা ঘর ছাড়ার তিন দিন আগে নিজেকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে নেয়। এজন্য তারা উপবাস থেকে কিছু বিশেষ নিয়ম পালন করেন। যাত্রার আগের দিন নদী বা পাহাড়ি ছড়ার তীরে গিয়ে মা কালীকে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে। যাত্রার দিনে মা কালীকে তারা পূজা দিয়ে যাত্রা সম্পর্কে নির্দেশনা প্রার্থনা চাওয়া হয়। মা কালী তাদের যে দিকে যেতে বলেন দলটি সে দিকে বেরিয়ে পড়েন। দলে অংশগ্রহণকারী সদস্যের স্ত্রীরা স্বামীর মঙ্গল কামনা করেন। যাত্রাপথে স্বামীর যাতে কোনো দুর্ঘটনা না হয় সে জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম পালন করে স্ত্রীরা। তারা ঝাড়ুর পরিবর্তে নিজের পরিধেয় শাড়ি দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে ওই সময় পর্যন্ত নিরামিষভোজী থাকে।
নিজ এলাকা ছাড়ার পূর্বে এই ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দলটি বিশেষ কিছু প্রস্তুতি নেয়। লালসালু দিয়ে বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরিধান করে বাদ্যযন্ত্র (ঢাক, করতাল, ঘণ্টা, খঞ্জনি ইত্যাদি) মা মণির (কালিমাতা)-র ছবি কাপড়ে মুড়িয়ে হাতে জয়পতাকা নিয়ে দলের সদস্যরা ১৩ দিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে এক চা বাগান থেকে অন্য চা বাগানে যান। যাবার পথে তারা বিশেষ কিছু স্থানে পাহাড়ি এলাকার বটগাছের নিচে ও মন্দির পেলে মন্দিরে অবস্থান করে পূজা করে বিশ্রাম নেয় ।
দলটি যে চা বাগানে প্রবেশ করে সে চা বাগানের সাধারণ চা শ্রমিকরা আন্তরিকতার সাথে তাদের গ্রহণ করে। তবে দলটি কারো বাড়িতে থাকে না। সেখানে এক বা দুই দিন রাত্রি যাপন করে।
সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক পূজা শেষে রাতে এ দলের সদস্যরা বিশেষ এক ধরনের ধর্মীয়-সামাজিক নাটক পরিবেশন করেন। এটি দেখার জন্য চা বাগানের সাধারণ মানুষজন বছরের এ দিনের অপেক্ষায় থাকে। এ চা বাগানের সকল ধরনের অসুখ-বিসুখ ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য নাটকের এক পর্যায়ে গভীর রাতে মা কালীকে আহ্বান করে।
চার প্রজন্ম ধরে এই বিশ্বাসকে ধারণ ও লালন করছে এই জনগোষ্ঠী। ঐতিহ্যবাহী ‘ডন্ড ব্রত’কে বাঁচিয়ে রাখছে নিজেরাই। কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা নেই বলে সদস্যরা জানান। উড়িয়া সম্প্রদায়ের চা শ্রমিকরা দাবি করে বলেন, তাদের এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে সরকারের সহযোগিতা করা উচিত। -ইত্তেফাক থেকে