আব্দুল ওয়াদুদ, মৌলভীবাজার থেকে।। সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠে সাংসারিক কাজে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ছুরই বেগম (৭০)। রাজনগর উপজেলার মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কে আসার আগেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। তাৎক্ষনিক চারদিকে থাকিয়ে কোথা থেকে আওয়াজ আসছে তা বুঝতে পারছিলেনা। গভীর ভাবে কান পেতে শুনতে পান হারিরাঐ গ্রামের পাশের ধান ক্ষেত থেকে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ আসছে। আওয়াজ শুনে ওই দিকে এগিয়ে যান তিনি। দেখতে পান কলাপাতায় মোড়া একটি ছেলে শিশু। কাদা ও পানির সাথে পড়ে থাকা ফুটফুটে শিশু নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। চোখ থেকে হয়তো তার পানি ঝড়ছিল না। হয়তো শুকিয়ে গিয়েছিল। তা দেখে হৃদয়টা মুচড়ে উঠে ছুরই বিবির। অধীর আগ্রহে তুলে নেন কোলে। মনে মনে বলতে থাকেন কে এই শিশু? কী তার পরিচয়? কে-ই বা রেখে গেল এমন পাষাণের মতো? নিজেদের যৌন চাহিদার ফসল অনাকাঙ্ক্ষিত এ শিশুটির জীবনকে এভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে, কে এই হতভাগী? ছুরই বিবির মনের মাঝে জেগে উঠা হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে চোখ তুলে তাকান তিনি আশপাশে। এ সময় তাকে দেখে কাছে আসেন আরো কয়েকজন কৃষক। খবর পৌঁছে যায় রাজনগর থানায়। রাজনগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আজিজুর রহমান ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে।
শিশুটির অবস্থা দেখে তিনিও মর্মাহত হয়ে এক পলক তাকিয়ে থাকেন। তিনি বিষয়টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্যামল বণিককে জানান। নিজের পকেটে থাকা কিছু টাকা দিয়ে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকৎসার জন্য পাঠিয়ে দেন এসআই আজিজুর রহমান। তিনি হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত শিশুটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। কিনে দেন নতুন জামা।
সম্প্রতি রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের হারিরাঐ গ্রামের ধানক্ষেতে পাওয়া ২০ দিনের বয়সী এ শিশুটির চিকিৎসা চলছে গত কয়েকদিন থেকে ওই হাসপাতালটির শিশু ওয়ার্ডে। দেখভাল করছেন ছুরই বিবি। এসআই আজিজুর রহমান নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছেন শিশুটির চিকিৎসা খরচ।
রাজনগর থানার উপপরিদর্শক আজিজুর রহমান রাজনগর থানার ১৬৭৯ নং জিডি মূলে এ বিষয়ে মৌলভীবাজার শিশু আদালতে একটি প্রতিবেদন পাঠান। শিশু আদালতের বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তার আদেশের একটি জায়গায় উল্যেখ করেন-
‘পাষন্ড পিতার ঔরসে জন্ম নেয়া শিশুটির কোনো দোষ থাকিতে পারে না- শিশুটির গর্ভধারিণী মায়ের দশ মাসের গর্ভধারণের জ্বালা তাহার রক্তে তিলে তিলে গড়া শিশুটি গ্রামের এক প্রান্তে পড়িয়া থাকিবে বা ফেলিয়া রাখিতে পারিবে গর্ভধারিণী মা বা জন্মদাতা পিতা- তা ভাবিতে গেলে উভয়কে পশুর চাইতেও বিবেকহীন, হৃদয়হীন, মানুষরূপী শয়তান বলিয়া বিবেচিত হয়।’
তিনি আরো লিখেন, ‘গর্ভধারিণী মা বা জন্মদাতা পিতার ঔরসে জন্ম নেয়া শিশুকে সেই পিতা-মাতা অভিভাবকহীন অবস্থায় গ্রামের এক প্রান্তে ফেলিয়া দিয়া যাইবে শিয়াল কুকুরের খাবার হিসেবে এমন অমানুষদের যৌন চাহিদা মিটানোর সকল উপযোগিতা নষ্ট করিয়া ফেলা উচিত বলিয়া প্রতীয়মান হয়।’ আদালত বিষয়টি প্রচারের জন্য পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও আদেশে বলেন।
এদিকে বিষয়টি জানাজানির পর থেকে এ শিশুটিকে দত্তক হিসেবে নেয়ার জন্য অনেকে আবেদন করেছেন। রাজনগর থানার উপপরিদর্শক এসআই আজিজুর রহমান বলেন, শিশুটি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেউ নিতে চাইলে আবেদন করতে পারবেন।