আব্দুল ওয়াদুদ, মৌলভীবাজার থেকে।। পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের পাহাড়ী এলাকার বড়লেখা, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ ও রাজনগর উপজেলায়ও চলছে অবাধে টিলা কাটা। পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধে প্রশাসনের উদ্যোগ না থাকায় ‘পাহাড়-টিলা খেকোদের’ আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। এছাড়া কখনও কখনও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের চোখের সামনেই ধ্বংস করা হচ্ছে পাহাড় টিলা।পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে অবাধে পাহাড়-টিলা কাটা চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকেন নীরব। এতে পাহাড়ের সবুজ বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে বন্যপ্রাণীরা হারাচ্ছে আবাসস্থল। অনেক সময় বাঘ, বানরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসে এবং প্রাণ হারায়। অতিবর্ষণে ভূমি ধসে ঘটছে হতাহতের ঘটনাও।
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস এলেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক ঘণ্টার শোভাযাত্রা ও আলোচনা ছাড়া পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আর কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয় না। যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার সৃষ্টি হয়নি। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, এ ব্যাপারে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের। পাহাড় ধসে যখন হতাহতের ঘটনা ঘটে তখনই ছুটে যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। হতাহতের পরিবারকে সহানুভূতি জানান। যৎসামান্য ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে। ২০১৫ সালের জুন মাসে জেলার রাজনগর উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের করিমপুর চা বাগানে টিলা ধসের ঘটনায় এক শিশু নিহত হয়েছিল। এ সময় আহত হয়েছিলেন আরো দুইজন। সূত্র জানায়, চা বাগানের উত্তরলাইন এলাকায় টিলার পাশে ঘর নির্মাণ করে বাগান শ্রমিক মণ্টু রায়সহ কয়েকটি পরিবার বাস করেন। প্রবল বর্ষণে টিলা এলাকায় ধসের আশঙ্কা করছিলেন বসবাসকারীরা। আর তাদের আশঙ্কা বাস্তবেই কাল হয়ে উঠে। আকস্মিকভাবে ওই টিলার একটি অংশ ধসে পড়ে মণ্টু রায়ের পাকা বসতঘরের ওপর। ধসেপড়া টিলার মাটি ঘরের দেয়াল ভেঙে তাদের চাপা দেয়। এতে ওই শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
২০১৪ সালের ১০মে ভোররাতে বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর চা বাগানে পাহাড় ধ্বসে একই পরিবারের তিনজন মারা যান। এ ঘটনার পর উপজেলা প্রশাসন তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নিলেও সারা জেলায় কোনো কার্যক্রম নেই। যার ফলে শতাধিক পরিবার চরম ঝুঁকি নিয়ে এই চা বাগানের টিলায় বসবাস করছে।
বর্তমানে বড়লেখা উপজেলার পাহাড়ি এলাকা সদর ইউনিয়নের ডিমাই, কেছরিগুল, গঙ্গারজল, দক্ষিণ ইউনিয়নের কাশেমনগর, হাকায়িতি, পূর্বহাতলিয়া, দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির বোবারথল, মোহাম্মদনগর, ছোটলেখা, ঘোলসা, মুড়াউল, অফিস বাজার, উত্তর শাহবাজপুর ইউপির বড়-আইল, নান্দুয়া, পূর্ব বাণীকোনা, শ্রীদরপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রকাশ্যে পাহাড় টিলা কাটা হচ্ছে। এসব পাহাড়-টিলা ধ্বংস করা হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়।
পাহাড়-টিলার মাটি বহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে শতাধিক ট্রাক্টর। এদের অধিকাংশেরই কাগজপত্র নেই। ট্রাক্টরের সাহায্যে মাটি বহন করায় উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ও উপজেলা সদরের শহরের প্রধান সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
এক মাস পূর্বে কুলাউড়া উপজেলায় পাহাড় কেটে রাস্থা নির্মাণ শেষ করে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালিক। দেড় মাস আগের ওই ঘটনার পর এলাকায় তোলপাড় শুরু হলে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবর বের হয়।
টিলা কেটে রাস্থা কেন নির্মাণ করলেন? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তখন তিনি জানান, এখানে আগে থেকেই রাস্তা ছিল। এই জায়গাটা একটু বেশি উঁচু ছিল। তাই পাহাড় কাটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, পাহাড় কেটে কোনোভাবেই রাস্থা নির্মাণ করা যাবে না। আর সরকারি অর্থ পাহাড় কাটায় ব্যবহার করা যাবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল জানান, পাহাড়-টিলা কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। তিনি জানান, পাহাড়-টিলা বা চা বাগানের পাদদেশে স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ আইনত অবৈধ। কিন্তু সার্বক্ষনিক নজরদারি এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অবৈধভাবে এসব স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এ কারণে পাহাড় ধসে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা।