মুক্তকথা নিবন্ধ।। বিচারক রাধাবিনোদ পাল, বাঙ্গালীদের মন থেকে হারিয়ে যাওয়া এক বাঙ্গালী মনীষা’র নাম। রাধাবিনোদের জন্ম ১৮৮৬সালে কুষ্টিয়ার সালিমপুর গ্রামে। রাধাবিনোদ জাপানীদের কাছেও এক মহান জাপানী বীর। জাপান সরকার এবং জাপানের সাধারণ মানুষ এখনও রাধাবিনোদকে স্মরণ করে। এই মানুষটির কারণে জাপানীদের কাছে বৃহত্তর বাঙ্গালীরা এক মহান জাতি। জাপানীরা অত্যন্ত ভালবাসার চোখে দেখে বাঙ্গালীদের। তারই সুযোগ্য উত্তরসুরী নাতি ভারতীয় রেভিন্যু সেবা কর্মকর্তা, সোমনাথ পাল, খ্যাতিমান তার নানাকে নিয়ে ইদানিং একখানা পুস্তক রচনা করেছেন। পুস্তকের নাম দিয়েছেন- ‘Radhabinod Pal: The forgotten Indian and the Japanese hero’।
মৌলভীবাজারের স্বনামধন্য পরিবার “আলীভাতৃত্রয়”এর বুনিয়াদের চতুর্থ পুরুষ, দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর সৌজন্যে, বাঙ্গালী এ মহানায়কের খোঁজ পাই আমরা। এমন মহাত্মার স্মরণ প্রকাশনাঙ্গনের মানুষ হিসেবে আমাদের দায়ীত্ব ও কর্তব্য মনে করে এর অনুবাদে মনোনিবেশ করি। এ কাজ কোন না কোন জ্ঞানপিপাসু ইতিহাস পছন্দ মানুষের আগ্রহী মনের চাহিদা পুরনে সহায়ক হবে। এ অনুধাবন থেকেই আজকের এ নিবন্ধানুবাদ। -সম্পাদক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে শুরু হয় মিত্রবাহিনীর দ্বারা ‘টোকিও বিচার’। সেই টোকিও বিচারের মিত্রশক্তির একমাত্র বাঙ্গালী বিচারক ছিলেন বিচারক রাধাবিনোদ পাল। বিচারক রাধাবিনোদ পাল সেদিন সকল জাপানী যুদ্ধবন্দীদের বেকসুর খালাস করে দিয়েছিলেন। এরা মিত্রশক্তির কাছে ছিল যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধের শেষ ফলাফলে ‘টোকিও বিচার’ দেখায়, কেনো একমাত্র বিচারক রাধাবিনোদ পাল জাপানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেয়ার মিমাংসা দেন। অতি অল্প ভারতীয় আর বাঙ্গালীরা এই রাধাবিনোদ পালকে আজকের দিনে স্মরণ করেন। রাধাবিনোদ ১৯৬৭সালে প্রয়াত হন।
২০০৭সালে ভারতে এক সফরের সময়, জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে ভারতীয় সংসদে বক্তব্যকালে রাধাবিনোদের স্মৃতিকে স্মরণ করেন।
এর পরই সিনজো কলকাতা চলে আসেন রাধাবিনোদের পুত্রের সাথে সাক্ষাতের জন্য। ১৯৬৬সালে, জাপানের সম্রাট বিনোদপালকে “Order of the Sacred Treasure First Class” সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। এটি ছিল জাপানের সর্বোচ্চ সম্মান। দূর্লভ এ সম্মান আরো যারা পেয়েছেন তারা হলেন- অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডমেন, সনি কোম্পানীর যুগ্ন প্রতিষ্ঠাতা আকিও মরিতা এবং টয়োটা মটর কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান সৈচিরো তয়োদা। টোকিও’র ইয়াসুকুনি মাজার, যেখানে জাপানী বীরদের স্মরনকরা হয়, সেখানে রাধাবিনোদ পালের নামে একটি স্মারক স্তম্ভ রয়েছে। এখানে জাপানী বীরদের স্মরনকরার সময় বিনোদ পালের উদ্দেশ্যে কিছু সময় দেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি, জাপানী নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য “দূরপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রইব্যুনেল(IMTFE)” নামে এটি গঠন করে এবং
রাধাবিনোদ পাল ছিলেন এই ট্রাইব্যুনেলের বিচারক। অন্যান্য ১০জন বিচারক ছিলেন আমেরিকা, ক্যানাডা, বৃটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সোভিয়েট ইউনিয়ন, চীন এবং ফিলিপাইন থেকে। এই ১১জনের আদালত সকলমূলে ২৫জন আসামীকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ৭জনকে মৃত্যুদন্ড, ১৬জনকে দেয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন এবং ২জনকে বিশ বছর তন্মধ্যে ৭বছর জেলে কাটানোর শাস্তি সাব্যস্ত করা হয়। রাধাবিনোদ পাল ছিলেন সেই রায়ের একমাত্র বিরোধীতাকারী বিচারক। তিনি সকল আসামীকে ক্ষমা করে দেন।
সকল দায়গুলোকে ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ এই ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। ‘এ’ ভুক্ত দায়গুলো ছিল শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ। ‘বি’ ও ‘সি’ ভুক্ত দায়গুলো ছিল যথাক্রমে প্রচলিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। রায় যে কি হবে তা সকল বিচারকেরই ধারনায় ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়েগেছে, মিত্রশক্তি জয়লাভ করেছে, ইতিহাস এখন তারাই রচনা করবেন। এমতাবস্থায় বিচার শুরু হওয়ার পরে রাধাবিনোদ পালকে বিচারক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল কেবলমাত্র বিচারক মন্ডলীতে এশিয়ান কেউ না কেউ আছেন শুধু তা দেখানোর জন্য। এমনকি অন্যান্য বিচারকদের তুলনায় তাকে টোকিও শহরের একটি নিম্নমানের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল।
মূল্যবোধে সাহসী রাধাবিনোদ পাল বিচারকদের বেঞ্চে একমাত্র এশিয়ান সাক্ষীগোপাল হতে বিরোধীতা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক আইনের উল্লেখ করে ভুল ধরিয়ে দিয়ে অন্যান্য বিচারকদের শুধু অবাক করেই দেননি, তাদের তিনি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। অনেকেই রাগান্বিত হয়েছিলেন কিন্তু সকলকেই হতবুদ্ধী করে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি আঙ্গুল দিয়ে ট্রাইব্যুনালকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, শান্তি ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে এমন দায় জাপানের উপর আনা যায় না। অতএব ‘এ’ ও ‘সি’ শ্রেণীর দায় অতীত দেখে এখানে আনা যায় না। জাপান যখন যুদ্ধে যায় তখন এ ধরনের কোন অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনে লিপিবদ্ধ ছিল না। অতএব খুব বেশী হলে জাপান স্বাভাবিক কিছু আইন ভঙ্গ করতে পারে। এইসব দায়ে আসামীদের বিচার করা হলে, ট্রাইব্যুনেল প্রচলিত ও গ্রহনযোগ্য সকল নিয়মনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করবে। এতে অভিযুক্তকরণই অগ্রহনযোগ্য হবে।
বিনোদ পাল বলেন, সরকারী ফরমান যা “টোকিও চার্টার” নামে অবিহিত, যা কি-না এই ট্রাইব্যুনেল গঠন করেছে, এ নমুনায় আসামীদের বিচার করা হলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের সকল মৌলিক শর্ত লঙ্গন। আর এরই নাম হলো পাপ। তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেন- “টোকিও চার্টার”এর সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ হবে সেসব বিষয় ও অপরাধের যা ট্রাইব্যুনেলের সামনে এসেছে। ট্রাইব্যুনেলের এটি নির্ণয় করা উচিৎ হবে যেসব কর্ম সংগঠিত হয়েছে সেগুলি যথাযথঃ আইনের আওতায় কোন অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কি-না? বিনোদপালের যুক্তিগুলো ছিল খুবই সাদাসিদে তবে অখাট্য ও অখণ্ডনীয়। তার যুক্তিপ্রদর্শনে ফরমান বা সনদ-এর কোন পরিবর্তন হয়নি ঠিকই তবে ট্রাইব্যুনেল যেভাবে যাওয়া উচিৎ সেভাবেই অগ্রসর হতে বাধ্য হয়েছিল।
“The very charter (known as the Tokyo Charter) that set up the tribunal, transgressed the fundamental rules of international law, said Pal. The Tokyo Charter, he argued, ought to decide merely what matters would come up for trial before the tribunal. It should be up to the tribunal to determine whether these acts constituted any crime under appropriate laws.”
বিচারক রাধাবিনোদ পাল তার ভিন্নমত পোষণকরা ১,২৩৫ পৃষ্ঠা মিমাংসায় লিখেছিলেন, “প্রতিহিংসার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ট্রাইব্যুনেল ছিলো আইনী পদ্বতির একটি জাল নিয়োগ।”
In his 1,235-page dissenting judgement, Pal wrote that the tribunal was a “sham employment of legal process for the satisfaction of a thirst for revenge”.
তিনি ট্রাইব্যুনেলের ব্যর্থতার প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছিলেন, যুদ্ধে বিজয়ীদের প্রতিশোধ নেওয়ামূলক কাজ ছাড়া অপরাধের আর কিছুই ট্রাইব্যুনেল হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন- “আমি এই বুঝি যে, যেসব অপরাধের দায়ে অপরাধী বলা হয়েছে সেসকল কারণে কাউকেই আমি অপরাধী বলে চিহ্নিত করতে পারি না এবং তাদের এসকল দায় থেকে মুক্তি দেয়া উচিৎ।”
He pointed to the “failure of the tribunal to provide anything other than the opportunity for the victors to retaliate”. He concluded: “I would hold that every one of the accused must be found not guilty of every one of the charges in the indictment and should be acquitted on all those charges.”
বিনোদ পালের যুক্তিতর্ক এতই শক্তিশালী ছিল যে ফরাসী ও ওলন্দাজ বিচারকগন প্রভাবিত হয়ে ভিন্নমতের বাড়তি বিবরণ লিখে পেশ করেছিলেন। যদিও তারা অন্য সকল মিমাংসার সাথে মতপোষণ করেছিলেন।
Pal’s arguments were strong enough to influence the French and Dutch judges; they submitted separate dissenting notes, though agreeing with the majority judgement of finding the defendants guilty.
প্রচলিত যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে আলাপ আসলে, যাতে বিনোদপাল আগেই সম্মত ছিলেন, তিনি বলেন, জাপানী সৈনিকগন তাদের অধিকৃত এলাকায় হিংসার আচরণ করেছে, বিশেষ করে চীনের নানকিং-এ তারা দানব ও শয়তান তূল্য চরম নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। এরপরও তিনি লিখেন, এই হিংস্র আচরণের জন্য উপরস্ত আমলা, মিনিষ্টার কিংবা উচ্চ সামরিক কর্মকর্তার কোন নির্দেশ ছিল এমন কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলতঃ এসব হিংস্র আচরণে যাদের পাওয়া গেছে এবং জীবন্ত ধরা হয়েছে তাদের এমনিতেই বিচার করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, অভিযুক্তরা মানবতার বিরুদ্ধে এমন কোন অপরাধ করেছে কি? যা আমেরিকা করেছে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে।
আমাদের অনুমান, বিচারক রাধাবিনোদ পালই বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি যিনি মিত্রশক্তির পক্ষের বিচারক হয়ে কাগজে-কলমে আমেরিকার পৈশাচিক এটমবোমা ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছিলেন।
তিনি লিখেন, “মেধা-বুদ্ধীর নির্ধারিত কোন সংরক্ষিত অংশে আইনের জিজ্ঞাসার মিমাংসা করা হয়না যেখানে আইনী মতবাদ ও কেবল বিবাদের স্থানীয় ইতিহাস থাকে, বাকী সবকিছু বলপূর্বক বাদ দেয়া হয়। আমরা বিশ্ব নিয়ে কিছুই জানিনা এমন ভাব দেখাতে পারিনা, যেখানে বিবাদ জেগে উঠে।”
“Questions of law are not decided in an intellectual quarantine area in which legal doctrine and the local history of the dispute alone are retained and all else is forcibly excluded,” he wrote. “We cannot afford to be ignorant of the world in which disputes arise.”
In his judgement, Pal questioned the very moral right of the Allies to condemn Japanese imperialism when large parts of humanity had been colonies of British and other Western powers for two centuries or more. Japan … annexing territories in East Asia and establishing protectorates, was merely following the Western example.
জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করার মিত্রদের নৈতিক অধিকারের প্রশ্নে পাল তার মিমাংসায় প্রশ্ন উত্থাপন করে লিখেন- যেখানে দুই শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে মানবতার এক বিশাল অংশ বৃটিশ এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির উপনিবেশ হয়ে আছে সেখানে জাপানী সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করার মিত্রদের নৈতিক অধিকার কি? নিজের কোন প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াই জাপান একটি দেশ উল্লেখ করে তিনি দেখান, পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে তাদের রক্ষাকবচ দিয়ে জাপান কেবল মাত্র বৃটেন ও পশ্চিমাবিশ্বকে অনুসরণ করেছে।
যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে বলতে গেলে যা বলতে হয়, তা’হলো এটি খুবই মজার বিষয় যে, শহুরে জনজীবনের উপর স্বেচ্ছায় সুচিন্তিতভাবে বোমা ফেলা হলো একটি শিল্প প্রধান শক্তির যুদ্ধের মূল কথা, যা শুরু হয়েছিল ১৯৪২সালের ১৪ফেব্রুয়ারী থেকে। বৃটিশ বিমান বাহিনীর নির্দেশে রাজকীয় বোমারু বিমান নেতৃত্বকে হুকুম দেয়া হয়েছিল এই বলে যে, “এখন থেকে তোমাদের অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো শত্রু জনমানুষের মানবিক মূল্যবোধের উপর…।” একারণেই বৃটিশ এবং আমেরিকান বিমান শক্তি পরে সাধারণ মানুষের উপর অগ্নিবোমা মারার সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া উন্নত করে যাতে অধিক মানুষের মৃত্যু হয় খুবই নিশ্চিতভাবে।
তিনি লিখেন, ১৯৪৫সালের ৯ ও ১০মার্চের রাতে, মানবেতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক বিমান হামলা ছিল, আমেরিকার বোমারু বিমান একটি বোমার আঘাতে টোকিও শহরে হত্যা করে প্রায় ১০০,০০০ সাধারণ নাগরীক। যা ছিল ২০ বা ৩০,০০০ বেশী হিরোশিমা ও নাগাশাকি শহরের মৃত্যু থেকে। ইদানিং বছরগুলোতে জাপানী শোধনবাদী ঐতিহাসিকগন বিনোদপালের আইনী মিমাংসার ওই অংশটি খুব ব্যবহার করেন তাদের যুক্তিকে জোড়ালোভাবে তুলে ধরতে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আগ্রাসনকারী বা দখলকারী ছিলনা।
On the night of 9-10 March 1945, in the single most destructive air strike in human history, American bombers killed an estimated 100,000 civilians in Tokyo—20,000-30,000 more than were killed instantly in Hiroshima or Nagasaki. In recent years, Japanese revisionist historians have used sections of Pal’s judgement to bolster their argument that the Japanese were not aggressors or invaders in World War II.
যুদ্ধে জাপানের ভূমিকায় বিনোদপাল সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি কখনও জাপানের ভূমিকাকে সমর্থন করেননি। তিনি যা বলেছিলেন তা’হলো জাপানকে তার সাম্রাজ্যবাদী তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এককভাবে দায়ী করা যায় না। ১৯৫২সালে জাপান সরকারের আমন্ত্রনে গিয়ে হিরোশিমায় এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, মূলতঃ এখন যদি জাপান চায় তাদের সামরিক শক্তি হিসেবে আবার গড়ে তুলতে, তা’হবে এই হিরোশিমায় এখানে যারা শোয়ে আছে সেদিনের সেই মৃত আত্মাদের কলুষিত করে কষ্ট দেয়া।
তার মিমাংসায় তিনি লিখেন, “আমার সন্দেহ নয় যে বিশ্বের প্রয়োজন একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলা আইনের ছত্রতলে, অথবা শুদ্ধভাবে বলতে গেলে, আইনের ছায়াতলে একটি বিশ্বসম্প্রদায়ের গঠন যেখানে জাতীয়তা বা বংশ কুল জাতিরা কোন স্থান খুঁজে পাবে না।”
In his judgement, he wrote: “I doubt not that the need of the world is the formation of an international community under the reign of law, or correctly, the formation of a world community under the reign of law, in which nationality or race should find no place.”
আজকের এ সময়ে সাহসী বিনোদ পাল নিয়ে পড়তে গেলে যা অবাক করে দেয় তা হল তার সাহস ও ন্যায়পরায়ণতা। যার জন্য তিনি তার নীতিবোধের উপর দাড়িয়ে নির্ভয়ে ট্রাইব্যুনেলের সতীর্থ বিচারকদের প্রবল চাপের মুখেও হাল ছেড়ে দেননি। ভারত যখন অস্বাভাবিক পরিবর্তনে দিকে যাচ্ছিল সে সময় পর্যন্ত ট্রাইব্যুনেলের কার্যবিবরণী অব্যাহত ছিল। ২৯এপ্রিল ১৯৪৬সালে ট্রাইব্যুনেল আবার বসে এবং চূড়ান্ত সাজা প্রদান চলে ১৯৪৮সালের ৪থেকে ১৪ডিসেম্বর পর্যন্ত।
রাধাবিনোদ পাল তার জীবনের ৬০টি বছর কাটিয়েছেন একটি অস্থির দেশে। যখন তিনি টোকিও আসেন, তখন স্বাধীনতা ছিল ঘরের দুয়ারে এবং একটি বাস্তবতা। ১৯৪৫এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে আজাদ হিন্দ ফৌজের শাহনেওয়াজ খান, গুরবক্স সিং ধীলন এবং প্রেম কুমার সাগলের বিচার চলছিল দিল্লীতে। তিনজনকেই ষঢ়যন্ত্র ও যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের যাবজ্জীবন নির্বাসন দণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু পরক্ষনেই অবস্থার বেগতি দেখে তাদের ৩জনকেই মু্ক্ত করে দেয়া হয়।
ভারত যখন স্বাধীন হয় এবং বিভক্ত হয়, তিনি জানতেন, এ সময় নিজের মাতৃভূমিতে যেসকল ঘটনা ঘটছে এ সবই তার খেয়ালে ছিল। দেশ ভাগের এ বিভক্তিতে পড়ে তার বাড়ীটিও তার ইচ্ছার বিপরীতে চলে যেতে পারে এটিও তার জানায় ছিল। তিনি এও জানতেন তাকে এ মোক্ষম সময়ে টোকিওতে থাকতেই হবে। বিনোদপাল তখন টোকিওতে কাজ করছেন। উপনিবেশকৃত এক বিশ্বের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অনেক দূরের এক অচিন অজানা দেশে কাজ করছিলেন তিনি। এই উপনিবেশকৃত বিশ্বের পক্ষ থেকে টোকিও ট্রাইব্যুনেলে তিনিই একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অন্যান্য বিচারকদের চেয়ে ট্রাইব্যুনেলও তার কাছে বহু কিছু আশা করছিল।
তিনি জানতেন তার দেশের মানুষ এসব বিষয়ে কোন ধারণাই রাখে না। তার পরও তিনি বুঝেছিলেন, অতীতের দূর্বিসহ উপনিবেশিকতা থেকে যে একটি নতুন জাতি স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছে সে গোটা জাতিরই মহান আদর্শের একজন ওজনদার প্রতিনিধি হিসেবে তাকেই এসময় এখানে থেকেই কাজ করতে হবে। থাকতে হবে, সে জাতির বহু প্রার্থিত গর্বিত এক ভবিষ্যতের আশায়।
বিনোদপালের টোকিও মিমাংসা প্রমান করে যে, তিনি সত্য সঠিক ও ন্যায্য বলে যা বিশ্বাস করতেন অন্য কোনকিছুই তাকে সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি সেদিন। একজন বিচারক হিসেবে এবং একজন ভারতীয় হিসেবে সেদিন তিনি কোন ধরনের স্বার্থের বশঃবর্তী হয়ে কিংবা বিজয়ী শক্তির ভয়ে ভীত হয়ে তার দায়ীত্ব থেকে একচুলও সরে আসেননি। আজ থেকে ৭০ বছর আগে টোকিও বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আজ এ দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষটিকে স্মরণ করার সময় এসেছে।
সূত্র: Editorial director Sandipan Deb, Swarajyamag.com. ও লাইভমিন্ট.কম থেকে অনুদিত। অনুবাদ: হারুনূর রশীদ