“উদীচী” বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। বর্তমানে সারাদেশে উদীচীর তিন শতাধিক শাখা রয়েছে। দেশের বাইরেও ছয়টি দেশে শাখা রয়েছে উদীচীর। যুক্তরাজ্যে উদীচী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালের ১৪ই অক্টোবর। তবে ১৯৮৮ সাল হতে উদীচীর চিন্তা নিয়ে কাজ করে আসছেন এমন তথ্য জানা যায় লেখক মাহমুদ এ রউফ-এর বিভিন্ন লেখা বই ও আলাপচারিতায়।
এবার ২০২৩, কেন্দ্রীয় সংসদ “সংস্কৃতির সংগ্রামে দ্রোহের দীপ্তি মুক্তির লড়াইয়ে অজেয় শক্তি” স্বরধ্বনিকে সামনে রেখে ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে। এদিকে, যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠাকাল হতে এখন পর্যন্ত ১৩টি কমিটি হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ৩১সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি হারুন অর রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক জোবের আখতার সোহেল।
উদীচী শব্দটির বীজ বপিত হয় আমার সেই শিশু বেলায়। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শাল্লা কলেজের নবীণ বরণ অনুষ্ঠান(১৯৮৭/৮৮) ও সারা গ্রাম জুড়ে বড় পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে। যিনি ঘটিয়ে ছিলেন তিনি আরেক হাওর প্রকৃতির পু্ত্র কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। উদীচী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও প্রতিষ্ঠাতা বা প্রতিষ্ঠাতাগনের সংগে তাঁর পরিচয় ঘটে ১৩৫০ বাংলার ফাল্গুন মাসে(১৯৪৩/১৯৪৪ সনে)। সুরমা উপত্যাকায় ৮ম কৃষক সম্মেলনে গণসংগীত পরিবেশনে। যেখানে আলোর দিশারীগন ছিলেন করুনাসিন্ধু রায়(কমরেড বরুন রায়ের বাবা), লালা শরদ্বিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য, সুরত পাল, বীরেশ মিশ্র, ইরাবত সিংহ, কমরেড মনিসিংহ, রাখাল বাবু, আদম আলী, তারা মিয়া, প্রবোধ নন্দ কর, সত্যেন সেন, রনেশ দাসগুপ্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী প্রমুখ। ফলশ্রুতিতে সেদিনের আলোর আভায় হয়তো তৎক্ষনাত-সময়ে না পারলেও আশির মাঝামাঝি কিংবা নব্বই দশকে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ গড়ে তুলেছিলেন হাওর বেষ্টিত শাল্লা উদীচী।
সত্যি বলতে কি, তাঁরা চিন্তায় ও মননে ছিলেন অনুসন্ধিৎসু। তাঁরা ছিলেন প্রগতির দূত। তাঁদের চিন্তা চেতনায় সমাজ আলোকিত, আমরা আলোকিত। তাঁরা আলোর দিশারী। তাঁদের পুঞ্জিভুত চিন্তাশক্তি দিয়েই আমাদের আলোর দিশারী ‘উদীচী’। উদীচী অর্থ উত্তর দিক বা ধ্রুব তারা’র দিক। দিকহারা নাবিকেরা যেমনি উত্তর দিকে ধ্রুব তারা’র অবস্থান দেখে তাদের নিজ নিজ গন্তব্য স্থির করে; তেমনি এদেশের সংস্কৃতি তথা গণমানুষের সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবকিছুই উদীচীকে দেখে তার চলার পথ চিনতে পারে।
বিলেতের মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বাঙ্গালীর মূল সংস্কৃতির গোড়াপত্তন, প্রগতিমনা সাংস্কৃতিক কর্মীকে একসাথে সংঘবদ্ধ করা ও নতুন প্রজন্মের মজ্জ্বায় বিস্তীর্ণের লক্ষ্যে, ৩৫ সদস্য ও ৩ উপদেষ্টার সমন্বয়ে, লুসি রহমানকে সভাপতি এবং সৈয়দ বেলাল আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথম উদীচী কমিটি মনোনীত করা হয়। নাটক সংগীতে বিভিন্ন দলে উপদলে ভাগাভাগি হয়ে উদীচী তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশ পরবাস হলেও বৈশ্বিক ও পাশ্চাত্য সমাজ সংস্কৃতির সাথে মানবিক ও প্রগতির কাজে সম ও সমান্তরাল ভাবে বুক চেতিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আলোর দিশারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তবে এখানেও যে উদীচীর উপর শকুনদৃষ্টির আচর পড়েনি তা কিন্তু নয়। কিছু গুষ্ঠী উদীচীকে করতে চেয়েছে পকেটস্থ। করতে চেয়েছে কোম্পানী। কিন্তু উদীচী কারো পকেটস্থও নয়; কোন কোম্পানীও নয়। উদীচী সবসময়ই গণমানুষের।
ঢেউয়ের তরঙ্গের ন্যায় কৌশলে উদীচী ‘সত্যেন সেন স্কুল অব পারফর্মিং আর্টস’ এর মাধ্যমে “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” সুনামে স্বনামে চমক দেখিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং স্বমহিমায় “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রসারিত হচ্ছে বিলেতের বিভিন্ন শহরে শাখা প্রশাখায়। এতো এতো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মাঝেও বিশ্বদরবারে মোড়লদের শোনাতে টেমসের পাড়ে বসে উদীচী শোনাচ্ছো সত্যেন-রনেশের একতারার সুর। ভোগবাদী সমাজে ঝড়েপরা প্রান্তজনের সুর। যে সুর পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতি কিংবা বুড়িগঙ্গা হতে আসলেও এখন প্রশান্ত, আটলান্টিক বা বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে সারা বিশ্বে বহমান সভ্য, সাম্য, সমতার খোঁজে কাজ করে যাচ্ছে উদীচী।
কারো লেখাতে একবার প্রকৃতিপুত্র রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পড়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথকে পড়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানা যায় কিন্তু একজন রবীন্দ্রনাথকে বানানো যায় না। যেমনি নজরুল, রোকেয়া, সুকান্ত, জীবনানন্দ এদেরকেও বানানো যাবে না, সর্বোচ্চ জানা যাবে। তেমনি পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতি নদী বিধৌত এক সময়ের নিচু ভূমি টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের পুত্র সত্যেন সেন(লস্কর) তাঁর আরেক কাণ্ডারি চায়ের নগরী আসামের ডিব্রুগড়ের পুত্র রনেশ দাশগুপ্ত যাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার গাউরদিয়া গ্রামে। এই উভয় শিল্পী সংগ্রামী বাঙ্গালির মননচর্চা ও মুক্তি-প্রয়াসকে বলবান করার ঋষিতুল্য কাজ করে গেছেন “উদীচী” প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তাঁদেরকেও বানানো যাবে না, সর্বোচ্চ জানা যাবে।
রাধারমন, হাছন রাজা, বিপিন পাল, মনিসিংহ, বারীন দত্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস হতে এযুগের বাউল আব্দুল করিম যাঁরা হাওরের কাদামাটি ভাসান পানির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ কিংবা চাঁন কপালী আফালের ঢেউয়ের প্রকৃত দৃশ্যের পটভূমিকায় যাঁদের জন্ম ও জীবন বাহিত হয়েছে; তাঁদের ধ্যান-ধারনা চিন্তা-ভাবনা, সমাজের আধাঁর দূরীকরনে সমাজ প্রগতির এক বড় আলোর মশাল। যা দেখে দেখে মুক্তমনা, মুক্তচিন্তার প্রজন্মরা সমাজ প্রগতির সামনের দিকে হাঁটছে। আলোর দিশারী হিসাবে কাজে লাগাচ্ছে। আর সেই কাজটি করে গিয়েছেন ১৯০৭ সালে জন্ম নেওয়া সত্যেন সেন(লস্কর), ১৯৬৮ সালের ২৯শে অক্টোবর উদীচীকে জন্ম দিয়ে।
আমরা জানি পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, বুড়িগঙ্গা ডিঙ্গিয়ে বঙ্গোপসাগর, কালীদহ মহাসাগর(সমগ্র ভাটি অঞ্চল, উল্লেখ্য মনসামঙ্গল)পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরের এপাড় ওপাড় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বে বাংলার গণমানুষের কাছে তেজস্বী ঢেউয়ের ন্যায় উদীচী একটি নাম।
যে ঢেউ ‘৬৮, ‘৬৯, ’৭০, ’৭১ কিংবা ৭৫-এর ১৫ আগষ্ট হতে বাংলার সংস্কৃতি জাতিসত্ত্বা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্প্রীতির উপর যখনই অপশক্তি কালো থাবার হুল ফুটিয়েছে তখনই অপশক্তিকে লন্ডভন্ড করে ছেড়েছে উদীচী। এদিক থেকে উদীচী দেশ ও সংস্কৃতির এক অতন্দ্র প্রহরী।