হারুনূর রশীদ।।
১৯৭১এর আগষ্ট মাসের কথা। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে অস্ত্র প্রশিক্ষন নিয়ে যখন দেশে ঢুকবো নেতারা ঠিক করলেন, সে সময়েরই একদিন সিলেটের আখতার আহমদ, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব, প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনিসহ কয়েকজন ভারতের আসারামবাড়ী ক্যাম্পে আমাদের শেষ নির্দেশনা দিতে এলেন। আমরা সকলেই তখন সিলেটের ছাত্রলীগ কর্মী। বিশেষ করে মৌলভীবাজারের। মূলতঃ মৌলভীবাজারেরই বিভিন্ন অংশে আমরা কাজ করবো। নেতারা বললেন, তোমরা দেশের ভেতরে যাবে কোন মূহুর্তেই ভুলে যেওনা যে তোমরা যুদ্ধের ময়দানে রয়েছো। যেকোন অমনযোগীতার সুযোগে শত্রুর হাতে জীবনহানী ঘটতে পারে। দেশের ভেতরে তোমারদের শত্রু শুধু পাক বাহিনী নয় আরো আছে। রাজাকার-আলবদর, মতিন-আলাউদ্দীন ও সিরাজ শিকদারের দলও তোমাদের চরম শত্রু। এ তিন-চার শক্তির বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াই করতে হবে। ভয়ে ভয়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম অস্ত্রনিয়ে দেশে গিয়ে প্রথম প্রথম আমরা থাকবো কোথায়? রবভাই-ই বলেছিলেন তোমাদের পথ দেখিয়ে যারা নিয়ে যাবেন প্রাথমিকভাবে তারাই এসব ঠিক করে দেবেন। তার পর তোমরা তোমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তায় নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে হবে। রবভাই নিজে থেকেই আরো বলেছিলেন, “দেশে এখন আইডেন্টি কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তোমরা চেষ্টা করবে সে কার্ড কোনভাবে নিজেদের নামে করিয়ে নিতে পারো কি-না। এতে তোমাদের যাতায়াতে খুবই সুবিধে হবে।” রবভাই আরো বলেছিলেন, “তোমরা দেশের ভেতরে যাবে, এমনওতো হতে পারে তোমাদের অনেকের সাথেই আর কোনদিন দেখা হবে না। তোমরা খুব সতর্ক থেকে কাজ করো।” এই বলে তিনি আমরা সকলের সাথে হাত ও বুক মিলিয়ে কিছুটা কাঁদো কাঁদো হয়েগিয়েছিলেন। ওখানে সেসময় আমরা যারা ছিলাম তাদের মধ্যে আমিই বয়োজ্যেষ্ঠ। দু’একজন বাদে বাকী সকলেই আমার দু’এক বছরের ছোট। তাদের আর কেউ কিছু বলতে যায়নি। রব ভাইয়ের সেদিনের কথা থেকে আমি বুঝেনিয়েছিলাম যুদ্ধ আমরাই করবো আর নেতারা ভারতে থেকেই আমাদের সহায়তা করে যাবেন। যুদ্ধের ময়দানে তারা যাবেন না। এতটুকু বুঝার পরও ‘স্বাধীনতা’ আর ‘মুক্তির যুদ্ধ’ শব্দগুলির সাথে এমনই আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে রবভাইদের নিয়ে সামান্যতম অবিশ্বাস কিংবা অশ্রদ্ধা মনে স্থানই পায়নি। খুব মনভরে তার কথা গুরুবাক্যের মত মাথায় তুলে রেখেছিলাম।
ছোট বেলায় মনে আছে একটুখানি ফুঁস আওয়াজ হলেই ভারতকে পাকিস্তান দোষ দিত আর ঠিক একই নমুনায় ভারতও পাকিস্তানকে দোষ দিত। একটু বড় হওয়ার পর কিভাবে কিভাবে বুঝতে শিখলাম যে দুই দেশের এই মহান গুণটি অর্জন হয়েছে তাদেরই পুরনো মালিক ইংরেজদের সৎসঙ্গে থেকে। জীবনের বেশ কিছুকাল স্থানীয় রাজনীতির অন্ধগলিতে হাটতে গিয়ে জানলাম শুধু দোষাদোষী নয় আরো অনেক জ্ঞানই ইংরেজগন ভারতীয়দের শিখিয়ে গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ওজনদার যে বিষয়টি শিখিয়েছে সেটি হলো-ভাগ করে শাসন করা।
রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে প্রথম প্রথম যেসকল জঠিল রাজনৈতিক সমীকরণের মুখোমুখি হই তার মাঝে এই ‘ভাগকরো শাসন কর’ মন্ত্রটিও ছিল একটি। নিজে থেকেই খুঁজে খুঁজে বুঝতে শিখি “ভাগ করে শাসন করো”এর মর্মকথা।
ইংরেজগন করতো কারণ তারা ভারতে এসেছিল ব্যবসা করতে। কিন্তু ভারতীয়দের কর্মের পরিহাস যে একসময় তারাই হয়ে গেলো রাজদণ্ডের মালিক। মালিক হয়ে যাবার পর তাদের সামনে দু’টো পক্ষই তারা দেখতে পেয়েছিল। প্রথম ভারতীয় মুসলমান যাদের হাত থেকে তারা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। অপর পক্ষ ভারতীয় শিখ, গুর্খা ও মারাটি যাদের ধর্ম পরিচয় তারা সকলেই হিন্দু। ক্ষমতা নিতে তারা ইংরেজকে সাহায্য করেছে। ইতিহাস বলে কি-না জানিনা, তবে খুব সাধারণ জ্ঞান বলে- তখনই তারা বুঝে নেয় যে পরাজিতদের পক্ষে আনা বা বশে আনা এতো সহজ নয়। বরং যারা সহায়তা করেছে নিয়মনীতি অনুসারে তাদেরই বন্ধু হিসেবে পাওয়া এ কঠিন সময়ের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়কে তারা হাতে নেয় আর মুসলমান সম্প্রদায়কে চরম বিরুধী ধরে নিয়েই তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। সেকাজ করতে গিয়ে খুব পরিস্কারভাবেই তারা দেখেছে এ দুই পক্ষকে যতদিন বিরুধী মনোভাবাপন্ন করে রাখা যাবে ততদিনই তাদের শাসন নিরাপদ থাকবে। তাদের সামনে সম্রাট বাবর, হুমাইউন ও আকবরের রাজ্য শাসনের নমুনা সুস্পষ্ট ছিল। তারা জেনেছে সম্রাট আকবর অন্ততঃ নিরাপদ শাসনের বিচারে হলেও এ দুই ধর্মাবলম্বীকে এক রাখতে গিয়ে নিজে ভিন্নধর্মী যোদা বাইকে বিবাহ করেছিলেন যোদা বাই-এর ধর্মাধিকার সংরক্ষন করে এবং তিনি খুবই সফল হয়েছিলেন। যোদাবাই সম্রাটের প্রাসাদে মন্দির বানিয়ে দেবতাকে পুঁজো দিতেন। সম্রাট প্রকাশ্যেই তা মেনে নিয়েছিলেন।
সম্রাট বাবর বুঝেছিলেন এবং জেনেশুনেই ভারতে পদার্পণ করেছিলেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্যে। বাবর দখলকারী ছিলেন কিন্তু দখলের পর লুণ্ঠনকারী হয়ে ধনরত্ন নিয়ে কাবুলে ফিরে যাননি। বরং দিল্লীতেই তার বসতঘরের ঠিকানা রচনা করেন। তারই সুযোগ্য উত্তরসূরী সম্রাট শাহজাহান বিশ্ব মানুষের অমর কীর্তি দুনিয়ার সেরা আশ্চর্য “তাজমহল” দিল্লীতেই নির্মাণ করেছিলেন। যার সুফল আজও গোটা ভারত ভোগ করছে। ভিন্ন পক্ষে ইংরেজরা বণিক থেকে রাজদণ্ড পেয়ে লুণ্ঠনে নেমে যায়। কারণ তারা বুঝতো এতো দূর দেশে যাদের সাথে ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি এমনকি প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন মিল নেই সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা যায়না।
সে উপলব্দি থেকেই ইংরেজগন একশত বর্ষ সারা ভারত লণ্ঠন করেছে একটি কোম্পানীর মাধ্যমে। আর এই লুণ্ঠন কাজ করতে গিয়ে তাদের মূল মন্ত্র ছিল “ভাগ করে রাখো ও শাসন করো”। তারা সফলভাবে তা করেছেও দ্বিশতবর্ষ ব্যাপী। এই করতে গিয়ে সেই যে আমাদের শিখিয়েছিল-‘ভাগ করে শাসন করো’, আমরা কিন্তু আজও তা নিজ মগজ থেকে সরাতে পারিনি। আমরা একবারও ভাবতে চাই না যে ওরা ছিল ভিনদেশী। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যা পাও তাই ঝুলিতে তুলে নাও।(চলবে)
লণ্ডন মঙ্গলবার, ১২ই মার্চ ২০১৯