মুক্তকথা প্রতিবেদন।। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন যদিওবা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারপরও বাংলাদেশের কিছু বলার থাকে। এই আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানকে এক করে দেখা হয়েছে। কারণ, এই আইনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশসহ এই দেশগুলো থেকে যারা নির্যাতিত হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিচ্ছে, তারা নাগরিকত্ব পাবে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে। যা সর্বাংশে সত্য নয়। ভারত শুধুই আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এমন নয়। তারও উপরে আমাদের কাছে ভারতের স্থান। আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যদিও সরকারে ছিল কংগ্রেস দল এর পরও কংগ্রেস ছাড়া অন্য যে কোন সরকার হোক, সে বিজেপি সরকার হোক বা অন্য কেউ হোক, তাদের আইনে বাংলাদেশকে সংশ্লিষ্ট করে এমন একটা কথা থাকবে তা বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কোন সময়ই আশা করে না। একইভাবে ভারতও আমাদের পক্ষ থেকে সরকারের জ্ঞাতসারে বা পরোক্ষ সহযোগিতায় হিন্দু বিতাড়ণ চলবে এমনটি কোনভাবেই আশা করে না। এবং বাংলাদেশে এমন কিছু হচ্ছে না যা হয়েছিল পাক-স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে।
ভারতের স্বাধীনতার ৭৩বছরের সূচনায় এসে নতুন করে নাগরীকত্ব যাচাই-বাচাই, ভারতীয় রাজনীতিতে একটি ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা ছাড়া এর অন্য কোন ব্যাখ্যা নেই। ভারতের এই অস্থিতিশীলতা দেশটির রাষ্ট্রীয় সংহতিকে নড়বড়ে করে তুলে, এর ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা যে থাকে, এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ভারতে যে বর্তমানে বিচ্ছিন্নতাবাদ নেই, তা নয়। বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদ সৃষ্টি হয় এবং হতে পারে। উত্তর ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আগেও ছিল এখনও যে নেই তা কোনভাবেই বলা যায় না। এখনও ওইসব স্থানে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছে। ভারতের মত দেশে অস্থিতিশীলতার অর্থই হল গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্থিতিশীলতা। সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশ বাদ পড়ে না। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ মামলার রায়, এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এ সবকিছুর মূলে রয়েছে ভারতের বর্তমান মৌলবাদী সাম্প্রদায়ীক শক্তির ক্ষমতারোহন। ভারতের ক্ষমতাসীন এই সাম্প্রদায়ীক শক্তির ঘোর সাম্প্রদায়ীক কর্মসূচী রয়েছে। খুব দক্ষতার সাথে তারা তাদের সে কর্মসূচী বাস্তবায়নের দিকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সেসব কাজে বা এই সাম্প্রদায়ীকতায় ভারতীয় “চিন্তাগুরু”দের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। না হলে দ্বিতীয় দফায় বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে না। ভারতের নিরীহ সাধারণ মানুষ না বুঝে এই “চিন্তাগুরু”দের কারণেই বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে বিপুল সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। যেমনটা হয়েছে আমেরিকায়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে আমেরিকার সকলেই এখন গালমন্দ করেন। অথচ আমেরিকার “চিন্তাগুরু”দের হয় সরাসরি অথবা মৌন সমর্থনেই ট্রাম্প ভোটে পাশ করেছিলেন। অন্ততঃ আমেরিকার মত উন্নত দেশে তাদের “চিন্তাগুরু”দের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া নির্বাচনে কেউ দাঁড়াতেই পারবে না। এর অর্থ হলো আমেরিকার সচেতন মহল ট্রাম্পকেই চেয়েছিলেন। তারা জানতেন ট্রাম্প পাশ করার পর কি কি করবে। জেনে শুনেই তারা ট্রাম্পের মত মানুষকে ক্ষমতায় আবাহন করেছিলেন। আমেরিকার হাতে রয়েছে ২৪৪ বছরের হিসাবের খাতা। এতো দীর্ঘ সময়ের বাধা-বন্ধনহীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার হিসেব এ বিশ্বের খুব কম দেশেরই আছে। যাদের আছে তাদের মাঝে আমেরিকা একটি। সেই মার্কিন দেশের রাজনীতির হিসেবের কোন খাতা নেই এ কথা দুনিয়ার কোন মানুষকে বিশ্বেস করানো যাবে না। মার্কিনীরা হিসেব ছাড়া এককদমও হাটে না। তাদের সবকিছুই হিসেব করা। কখন কোথায় কোন দেশে কাকে সংঘে নিয়ে বন্ধুত্বের খাতায় সই দিতে হবে কিংবা কোথায় কি নমুনায় যুদ্ধ বাধাতে হবে সবকিছু তাদের হিসেব করা। আর দেশের প্রেসিডেন্ট কে হবে মার্কিনীরা আগে বুঝে নাই এমন ভেল্কিবাজী কথা সারা দুনিয়া বিশ্বাস করলেও আমরা বিশ্বাস করি না।
ভারতের বিষয় হুবহু না হলেও অনেকটা সেরকমই। না হলে গুজরাতের নরহত্যাযজ্ঞের নায়ক কি করে ভারতের মত অসাম্প্রদায়ীক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। গুজরাট হত্যাযজ্ঞের পর আমেরিকা দু’বছর তার আমেরিকায় প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল। সেই আমেরিকা আবার তার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল। সবখানেইতো কিছু না কিছু লেন-দেন আছে! মোদ্দাকথা ধনবাদী সব দেশেই ভোটে জিতে নেয়ার জন্য সাম্প্রদায়ীকতাকে ব্যবহার করা হয়। এটি নতুন কিছু নয়। এখনতো আম-খাস সকলেই রাজনীতির এই গুটি চালের বিষয়ে খোলা-মেলাভাবেই জানেন। চলমান ভারতের রাজনৈতিক পথ বাংলাদেশ অনুসরণ না করলেই বাংলাদেশ বাঁচে। বিশ্বব্যাপী এই ডানের দিকে ধাবিত হওয়ার ঝোঁক অতিসম্প্রতি শুরু হয়েছে এমন নয়। আমাদের হিসেবে ১৯৮৫সালে রাশিয়ায় যখন গর্বাচেভ কম্যুনিষ্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে আসেন তখন থেকেই এই মহামারি শুরু হয়। তার সংস্কারবাদী(পেরেস্ত্রয়কা) আচরণের কারণে যে দানবের জন্ম হয়েছিল সে বিষয়ে বলতে গিয়ে গর্বাচেভ নিজেই বলেছিলেন, “ওরা সিগারেটে আগুন ধরানোর জন্য সারা দেশটায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।”
এ কথা তার নিজের ভুলের খেসারতের কথা। সেই গর্বাচেভের আমল থেকেই গোটা বিশ্বের রাজনীতি সেই যে ডানদিকে মোড় নিতে শুরু করেছিল আজও সে পথেই হাটছে। সেই থেকে আজ অবদি অনেক দেশেই ডানপন্থিরা ক্ষমতায় আসছে। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। ভারতের এই নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাশ হওয়ার পর ভারত যতই এটিকে নিজেদের আভ্যন্তরীন বিষয় বলে না কেনো এটি এখন আর শুধু তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকেনি। বিষয়টি যেহেতু অন্য দেশকে নিয়ে কথা বলে তখন এটি আর অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেছেন তবুও তার উদ্বেগের কথাও বলেছেন। ভারতের এই নাগরীকত্ব বিল ধর্ম নিরপেক্ষ থেকে মৌলবাদী ডানের দিকে পেছনে হাটা। এই আইন পাস হওয়ার পর বাংলাদেশের দুটি উচ্চ পর্যায়ের সফর বাতিল হয়েছে। এটি অবশ্যই ভারতের প্রতি বাংলাদেশের বিশেষ বার্তা বহন করে।
বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের “চিন্তাগুরু”দের যে দূর্ভাবনা ছিল বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ সে দূর্ভাবনাকে অবশ্যই দূর করে দিয়েছে। কিন্তু ওই তুলনায় ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ দেখা বা বলার মত কিছুই এখনও পায় নি। হারুনূর রশীদ, লণ্ডন রোববার ১৯জানুয়ারী ২০২০সাল