হারুনূর রশীদ।।
গোচোনার চাহিদা এমন মাত্রায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে বহু পরীক্ষিত চিকিৎসা পদ্বতির বিকল্প হিসেবে অনেকটা হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। এই হুমকি কথাটির প্রশ্নে আমাদের ধারণা একটু ভিন্ন। প্রশ্ন হচ্ছে এ হুমকি কার জন্যে? নিশ্চয়ই দেশী-বিদেশী বড় বড় ঔষধ বিক্রেতাদের কাছে এটি একটি হুমকি। মানবজীবন নাশক কোন হুমকি নয়। আজ অবদি গোচোনা খেয়ে কিংবা ঘরে বা জমিতে গোবর ব্যবহার করতে গিয়ে কোন প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে এমন কোন সংবাদ কোথায়ও শুনিনি।
অবশ্য গোচোনার এমন মহৌষধি গুণাগুণ গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাজারে নিয়ে আসা উত্তম। এ বিষয়ে বিষদ গবেষণার প্রয়োজন। আশার কথা যে ভারত তা শুরু করেছে।
একটি সংবাদ মাধ্যমের কাছে জয়পুরের একজন দুধ খামারের মালিক বলেছিলেন তার আয় কমপক্ষে শতকরা ৩০ভাগ বেড়েছে। গাভীর চোনার এই অকল্পনীয় চাহিদা স্বচক্ষে দেখতে হলে জয়পুরের যেকোন ভূষিমালের দোকানে গেলেই দেখা যাবে মাল-সামানার থারিয়ায় খুব সুন্দর ও যত্ন করে পুষ্ঠি ও মজাদার খাবার পানীয়ের সাথে গোমূত্রের বোতল রাখা আছে। উদ্ভূত চাহিদা মেটানোর জন্য গোমূত্র এখন প্রতি লিটার ভারতীয় মুদ্রায় ৩০রুপি হারে রাজস্থানে বিক্রি হচ্ছে। জানা গেছে, দুধের চেয়ে গাভীর চোনা এখন বেশী আয়ের পথ করে দিয়েছে দুধ খামারীদের। দুধের দাম যখন প্রতি লিটার ২২ থেকে ২৫ রুপি তখন গাভীর চোনার লিটার ৩০রুপি।
ভারতে বিশেষ করে রাজস্থানে জৈব খামারীদের কাছে গোমূত্রের কদর খুব বেশী। এছাড়াও গোমূত্র ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে এমনকি ডাক্তারী কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। ‘গুজ্জর’ নামের রাজস্থানের একজন কৃষক সংবাদ মাধ্যম ‘টাইমস অব ইণ্ডিয়া’কে একসময় জানিয়েছিলেন যে গাভীর চোনা যাতে মাটিতে পড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য তিনি সারারাত জাগিয়ে কাটান। গুজ্জর একা নন একাজে, দুধ খামারে গুজ্জরের মত আরো বহু আছেন যারা গোচোনা সংগ্রহের জন্য রাতে পাহাড়ায় থাকেন যাতে চোনা মাটিতে পড়ে না যায়। গৃহপালিত গাভী থেকে শুরু করে খামারের গাভী সবখানেই গোচোনার চাহিদা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে কৃষক-খামারীদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে।
এখানে একটি প্রত্যক্ষ উদাহরণ দিলেই বুঝা যাবে গোচোনার চাহিদা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁচেছে। উদয়পুরের সরকার পরিচালিত “কৃষি ও কারিগরীর মহারাণা প্রতাপ বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিমাসে ১৫ থেকে ২০হাজার রুপির গোচোনা ক্রয় করে থাকে তাদের জৈবখামার প্রকল্পের জন্য।
ভারতের রাজস্থানে সরকার পরিচালিত ২,৫৬২টি গাভী আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা, ২০১৬সালে কর্মীদের অবহেলার কারণে জয়পুরের কোন একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫শত গাভী মারা গিয়েছিল। ফলে ওই সময়ে জয়পুর উচ্চ আদালতের বিচারক মহেশ চান্দ শর্মা, স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রের প্রতি দাবী জানিয়েছিলেন গাভীকে জাতীয় পশুর মর্যাদা দেয়ার জন্য। তার দাবীতে বিচারক শর্মা তখন বলেছিলেন, “এটি বিশ্বাস করা হয় যে ৩৩কোটি দেব-দেবী এই গাভীর ভেতরেই বসবাস করেন। গাভীই হলো একমাত্র জীবিত প্রাণী যাহা না-কি অক্সিজেন গ্রহনও করে আবার বাহিরও করে।”
ইতিপূর্বে গোমূত্র ভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। অবশ্য বৃহৎ ভারতীয় অঞ্চলে গরুর গোবর ও চোনা বাড়ী-ঘর রোগবালাই মুক্ত রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। গরুর গোবরতো এখনও বিশ্বের সর্বত্র মাটির উর্বরাশক্তি বাড়াতে কাজে লাগানো হয়ে থাকে। তবে সেগুলো চলে আসছিল বা এখনও চলছে প্রচলিত প্রথা হয়ে। এর পেছনে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই। কিন্তু এখন এর চাহিদা এমন মাত্রায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে বহু পরীক্ষিত চিকিৎসা পদ্বতির বিকল্প হিসেবে অনেকটা হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। কিন্তু আমরা বুঝি এটি কোনভাবেই হুমকি নয়। এগুলো কিছু বিদেশী মাধ্যম আর তাদের তাবেদার কিছু করপোরেট ঔষধ ব্যবসায়ীদের চিন্তা।
অবশ্য এই গোচোনা নিয়ে গুজবেরও কমতি নেই। গুজরাটের জুনাগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাণী কারিগরী বিজ্ঞানী দাবী করেন যে গাভীর চোনা কয়েক নমুনার ক্যান্সার রোগ নিরাময় করে। পরে অবশ্য কিছু ‘অনকোলজিষ্ট’ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে এমন কোন রোগীর উপর ব্যবহার করে দেখা হয়নি যে গোচোনা ক্যান্সার নিরাময় করে।
গোমূত্র ক্যান্সার নিরাময় করে এমন বিশ্বাসে হয়তো একটু চির ধরেছে কিন্তু বাড়ী-ঘর পরিষ্কার নিরাময় রাখতে গোমূত্র খুবই কাজ করে এমন বিশ্বাস বহু পুরানো এবং এখনও মানুষের মনের মাঝে এ বিশ্বাস একটি স্থায়ী জায়গা করে রেখেছে। এ চিন্তাকে সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে ২০১৫সালের মে মাসে রাজস্থানের চিকিৎসা ও স্বাস্থ মন্ত্রী রাজেন্দ্র রাথোর ‘জালোর’-এ একটি গোমূত্র শোধনাগারের উদ্ভোধন করেন। ওই উদ্বোধনের সময় রাথোর বলেছিলেন জয়পুরের এস এম এস হাসপাতাল পরিষ্কার রাখতে এখন থেকে গোমূত্র থেকে প্রস্তুত একটি জিনিষ ব্যবহার করা হবে। ওই একই সময় সমগ্র এশিয়ার মাঝে সবচেয়ে বড় গোশালা(গরুর নিরাপদ আশ্রয়)র একজন প্রধান দীনেশ গিরী মহারাজ বলেছিলেন কীট নাশক হিসেবে গোচোনা থেকে প্রস্তত ঔষধ জৈবখামারের জন্য আশীর্বাদ হবে।
হারুনূর রশীদ, শুক্রবার ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৮সাল। সূত্র ও ছবি: বিজনেস টুডে, টাইমস অব ইণ্ডিয়া