মুক্তকথা নিবন্ধ।। ফাহাদ মোহাম্মদ বাংলাদেশ পুলিশের একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট। তিনি আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে খুবই সংবেদনশীল মনোজ্ঞ একটি রচনা লিখেছেন “বাংলার আলো.নেট” নামের অনলাইনের ‘মুক্তচিন্তা’ নামের কলামে। আমাদের এক সুহৃদ লিখাটি পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। সার্জেন্ট ফাহাদ খুবই আবেগ ও দরদ দিয়ে আমাদের শিক্ষার অতীত বর্তমানকে গভীর থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার শুরুতেই বলেছেন-“দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত জন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করেছে তার সিকিভাগও সৎ লোকের সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা ও দেশ প্রেমের শিক্ষা দেওয়া হয় না।” তিনি তার শিক্ষা জীবনের উল্লেখ করে বলেছেন- “আমার সামান্য শিক্ষাজীবনেও খুব কম শিক্ষক(১/২ জন) পেয়েছি যিনি আমাদের দেশ প্রেম এবং নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। স্যারেরা ক্লাসে এসে একটা টপিকের উপর আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করেন।…।”
এমন সহজ সরল ভাষায় বাস্তবতার গভীরের খাঁটী কথা আর কি হতে পারে। ফাহাদ মোহাম্মদ তার পুলিশের চাকুরীর বিষয়ে যে কথাটি বলেছেন তার জবাবে কারো কিছু বলার আছে বলে আমরা মনে করিনা। ফাহাদ লিখেছেন-“চাকরিজীবনের ট্রেনিংয়ে যে কয়জন শিক্ষক পেয়েছি তাদের অনেকেই সৎ এবং খুব দক্ষ ছিলেন। তারা নিয়মিত পুলিশিংয়ে ঠিকতে পারেন না। তাই দেশের মানুষ সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ পুলিশ চোখে দেখে না। সৎ সরকারি চাকুরীজীবী মানুষ দেখে না।…”।
এক অব্যক্ত বেদনাকাতর মন থেকে সার্জেন্ট ফাহাদ লিখেছেন- “এই দেশে যারাই দুর্নীতি করে তারা কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে ভালো ছাত্রদের একজন। কারণ ভাল ছাত্র ছাড়া ভাল চাকরী করা সম্ভব নয়। যারা আমার মতো নিম্নতর স্থরের ছাত্র তারা বড় কোনো চাকরী পায় না। বড় চাকরি বেশিরভাগ পায় মেধাবীরা। আমার দেশের কৃষকেরা দুর্নীতি করে না। কুলিকামার দুর্নীতি করে না। এরা দুর্নীতির শিকার হয়। দুর্নীতির কারণে এদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তবু তারা জমির খাজনা দিয়ে দেশে শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টি করে।”
আমাদের সুপরিচিত তমগাধারী লেখক সমাজদর্পণীদের লেখনিতে এসব কথা নিয়মিত আসতে আমরা দেখি কম। স্বাধীনতার ৪৮বছর পরও আমরা নিজেদের আখের গোছানোর কাজ শেষ করতে পারিনি। এখনও আমাদের লেখক সাংবাদিকগন নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। গড়ে উঠার পথে দেশকে সময় দেয়ার সময় তাদের নেই।
জনাব ফাহাদের লিখায়, দেশের চলমান অবস্থার কারণে তার মনোজগতে এক দূর্বিসহ যন্ত্রনায় কাতরানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। এখানে তিনি লিখেছেন- “দেশের সব থেকে মেধাবীরা ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হয়। তার পরের স্থরের মেধাবীরা হয় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রাজনীতিবিদগনও মেধাবী উচ্চশিক্ষিত। এমনকি তাদের একটা বিঢ়াট অংশ মহান মুক্তিযোদ্ধে আত্মত্যাগকারী, জীবন উৎসর্গকারী বীরদের সন্তানও আছেন। তবুও দেশে অনিয়ম কমে না। দুর্নীতি কমে না। তার কারণ কি? তাহলে কি ধরেই নিবো যতবড় মেধাবী ততবড়……?”
তার এই ধ্বনিগুলো কি প্রতিধ্বনি করে(?) এটি দেখার কি কোন প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে লজ্জ্বা আর বেদনার কি হতে পারে?
সার্জেন্ট ফাহাদের লিখার জবাব নেই। চলমান সমাজের একেবারে গভীরে যে খাঁটী বাস্তবতা বিরাজমান তাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে তার ধীকৃতির মনোভাব থেকে। এ সমাজ, এ ব্যবস্থা তার কাছে অনভিপ্রেত। তাইতো তার বলিষ্ট সুস্পষ্ট ঘোষণা- “আমার মধ্যে যতটুকুই(অতি সামান্য) সততা এবং নৈতিকতা আছে তার বেশিরভাগ আমি পরিবার থেকে শিখেছি। আমি দেখেছি আমার বাবা সর্বোচ্চ সুযোগটুকু পেয়েও অসত উপায় অবলম্বন করেন নি। নিজের সম্পত্তি নষ্ট করেছেন কিন্তু সততা নষ্ট করেন নি। আমি যতটুকু অসত তা আমি রাষ্ট্রের পরিবেশ থেকে শিখেছি। আমি দেখেছি এই দেশে শত অনিয়ম করার পরেও সবাই তাকেই সম্মান করে। আমি দেখেছি যাদের টাকা ও ক্ষমতা আছে তারাই সমাজের কাছে সম্মানিত। যেকোনো অনুষ্ঠানে অতিথির আসন সেই অলংকৃত করে।”
“তাহলে আমি বা সে যারাই চাকরিতে আসে তারা সৎ থাকবে কেন? সৎ থাকার কোনো লজিক আমি এখন পর্যন্ত এই সমাজে দেখিনি। আমি আমার সন্তানকে কোনোদিন ভাল কাপড় দিতে পারবো না কিংবা ভাল স্কুলে পড়াতে পারবো না। …কিন্তু সরকারী অফিসের একজন পিয়নের একটা বড়সড় বাড়ি থাকবে। আমি ঠিকমত ডাল ভাত খেতে পারবো না আমার সামনেই এমএলএসএস বাজারের সব থেকে বড় মাছটা কিনে নিবে।”
“যে যতটুকু অসত তার জন্য রাষ্ট্র দায়ী এর শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী। যেই যতটুকু দুর্নীতিবাজ তার জন্য এই সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। আর যে যতটুকুই সৎ তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কেবল তার। কৃতিত্ব তার পরিবারের। কৃতিত্ব আরেকজন সৎ লোকের।…”। তার লিখায় স্ফুলিংগ আছে কিন্তু একটি জিনিষ নেই আর তা হলো অপরাধ, দূর্ণীতি, অবক্ষয় আর দূর্বৃত্তপরায়ন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের হুঙ্কার। অনলাইন মুক্তচিন্তা থেকে সংগৃহীত তথ্য।