হারুনূর রশীদ।।
ধীরস্রোতা ছড়া তীরে ডাহুক ডেকে যায়। হাম হাম চলে নিজের মত আগের ঠিকানায়। অগনিত কাল নিজের ইচ্ছায়ই চলে আসছিল সে। চলনে- আচরণে প্রকৃতির যৌবনবতী সুদর্শনা কন্যা “হাম হাম”! কোন কালেই কারো কোন ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেনি সে।
মানুষতো বটেই; বাঘ-ঘোগ, মোষ-মেষী, শূকর-শূকরী, হাতি থেকে শুরু করে কত শত সহস্র লক্ষ কোটি বোনেলা তৃষ্ণার্থ প্রাণী আর সরিসৃপ নিঃশব্দ দুপুরে কিংবা গোধূলি লগ্নে তার পানি পান করেছে; নিকশকালো নিশুতি রাতে তার পাথুরে শরীরের নিকুঞ্জ মাড়িয়ে চলেছে লক্ষকোটি বছর সে হিসেব কেউই রাখেনি। কত কত প্রাণী তার চারদিকের ফল-মূল লতাগুল্ম খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে চলেছে তা দেখার কোন প্রয়োজনই হয়নি তার। কত শতকোটি অগনিত মায়াবী মৃগ তার নিকশকালো পাষাণ বুকে মুখ লাগিয়ে পানি পান করে জীবন রেখেছে, কোনদিন সে কিছু বলার প্রয়োজন অনুভব করেনি। কারণ তাকে কেউ স্পর্শ করতে পারেনি নিঠুর কঠিন হাতে।
কিন্তু হাজার লক্ষ বছর পর হঠাৎ একদা কি ঘটে গেলো সে পুরো আঁচ করতে পারেনি। প্রথম প্রথম সে স্পর্শে হঠাৎ আলোর ঝিলিকে সে উল্লোসিত হয়ে আগের মতই আচড়ে পড়েছে নিচে। কিন্তু এখন?
এখন যেনো তার চলার গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। সুদীর্ঘ যৌবনের উন্মত্ততা যেনো কোথায় হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। আগের মত প্রচণ্ড গর্জনের ‘হাম হাম’ হুঙ্কার এখন আর আগের মত শোনা যায় না। বরং এবার উদোম হয়ে যাবার দিগম্বরী ভয়ে তাকে ভীত মনে হয়।
অথচ একসময় নিজ গন্তব্যে পৌঁছার সাহসী চলার উন্মত্ততায় উম উম শব্দের ভীষণ গর্জনে চলেছে সে। মনে হতো চারদিকের আলো-বায়ূকে জানান দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে চলছে প্রিয়জনের মিলন আকাঙ্ক্ষায়।
সে চলায় চারদিকের প্রকৃতিই ছিল তার নান্দনিক সাজ। সাগরই ছিল তার শেষ গন্তব্য। সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে সুদীর্ঘকাল ধরে বয়ে চলেছে। জনচক্ষুর অন্তরালেই ছিল অজানা অগনিত কাল। এই সেদিন মানবচক্ষুর সামনে এসেছে। প্রকৃতির ঘন ঝোপঁঝাড়ে আবৃত থেকে এতোদিন নিরুপদ্রবে চলে আসছিল “হামহাম”। প্রকৃতির বন্যদাপটে কেউ কাছে ভিড়তে পারেনি। দূর থেকে মানুষ তার চলার তীব্র হুঙ্কার শুনেছে। কিন্তু এখন, এখন থেকে কি শুরু হবে সে কিছুই জানেনা এখনও। বুভুক্ষ ক্ষুধার্থ মানুষের করাল রোষে একি তার হারিয়ে যাবার প্রায়শ্চিত্বের পালা, না-কি দীব্যজ্ঞানী মানুষের আশীর্বাদি পরশে কোন নবরূপে আবির্ভাবের অনাবিল সূচনা সে তার কিছুই বলতে পারেনা। কিন্তু কি যেনো হারানোর বেদনা মিশ্রিত কান্না তাকে তাড়িত করছে এখন থেকে।
উপর থেকে গভীর নিচে পানি পড়ার শব্দকে সিলেটের স্থানীয় কথ্য ভাষায় ‘আম আম’ বা উম উম শব্দ কয়টি দিয়ে বুঝানো হয়ে থাকে। যেমন, “আ-ম আমাইয়া পানি পড়ের” অথবা “উম উমাইয়া পানি পড়ের।” এর অর্থ হলো ভীষণ শব্দে পানি পড়ছে বা প্রবাহিত হচ্ছে। আর এমন অবস্থা বড় আকারের নদী ভাঙ্গন বা ঝর্ণা ছাড়া আর কিছুর হবার কথা নয়।
সিলেটের বাহিরের লোকজন আম আম বা উম উম শব্দকে হাম হাম উচ্চারণে প্রকাশ করে থাকেন। এই ‘আম’ ‘আম’ বা উম উম থেকেই হাম হাম ঝর্ণার নামের উৎপত্তি। “হাম হাম” বাংলাদেশের একমাত্র বড় ঝরণা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বন এলাকার অনেক গভীরে রয়েছে কুরমা বন বিট এলাকা। এই কুরমা বন বিট এলাকায়ই রয়েছে “হাম হাম” নামের ওই প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝরণা।
অনেকেই লিখতে গিয়ে লিখেছেন যে তুর্কী শব্দ “হাম্মাম” থেকে “হাম হাম” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। সবই অনুমান। হাম্মাম অর্থ গোসল বা স্নান। এই অদেখা অঘোর জঙ্গলে কে আসবে গোসল করতে! তা-ও আবার তার্কিশ মানুষ। সে থেকে অনুমান করলে ভুল হবে না যে হাম্মাম নয় বরং পানি পতনের ‘হাম হাম’ শব্দ থেকেই “হাম হাম” নামের উৎপত্তি হওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
স্থানীয় লোককাহিনী ছাড়া এ নামের বিষয়ে অন্য কোন তথ্য প্রমানাদি কোথায়ও আছে বলে আজ অবদি জানা যায়নি। স্থানীয় এই লোককাহিনীর উপর ভিত্তিকরে ২০১১ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত কিছু সংবাদপত্র ও দু’একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম “হাম হাম” ঝর্ণার উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এগুলো ছাড়া এই নামের বিষয়ে অন্য কোন তথ্যনির্ভর প্রমানাদি পাওয়া যায়না।
উইকিপিডিয়া লিখেছে, জলপ্রপাতটি ২০১০ খ্রিস্টাব্দের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। এই পর্যটক দলের আর কোন বিবরণ পায়নি উইকিপিডিয়া।
২০১০সালকেই আবিষ্কারের বছর ধরে নিলে আজ ৮ বছরে পা দিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আজও পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানো পৌঁছার কোন যুৎসই রাস্তা তৈরী হয়নি। পরিবার পরিজন শিশুপুত্র নিয়ে একেবারে কাছে থেকে নিরুপদ্রবে দেখার উন্নত সুযোগ আজও নাগালের বাইরে। বরং বহু পর্যটককে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঝর্ণায় নেমে গিয়ে গোসল করতে দেখা যায়। যা কোনভাবেই নিরাপদ নয়। মানুষের জীবন ও ঝর্ণার পরিবেশ রক্ষা উভয় কারনেই ঝর্ণায় নেমে গোসল নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
শুধু মুখ দিয়ে সকলেই পর্যটন নগরী বলে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছেন। প্রকৃতি পরিবেশ নষ্ট না করে উন্নতমানের যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরী সকলের কল্যাণ বয়ে আনবে এ বিষয়ে সুর তুলে সকলেই বলেন। কিন্তু কাজটি হচ্ছে না কেনো? আজও জানাই হলো না!
লণ্ডন, শুক্রবার ৬ই জুলাই, ২০১৮সাল