মুক্তকথা নিবন্ধ।। গত আগষ্টে “ন্যাশনেল ক্রাইম এজেন্সি”কে ৪৭২,৭৪০ পাউণ্ড জরিমানা দেয়ার জন্য কাশাফ আলী খান নামের ৪৫বছর বয়সের একজন কালোটাকার কারবারীকে আদালত নির্দেশ দিয়েছে। পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত কাশাফ আলি বৃটেনের ছলিহাল শহরে ৪১৩,০০০পাউণ্ড দিয়ে একটি বাড়ী খরিদ করেছিলেন। পুলিশকে তার অর্থের উৎস জানাতে চাইলে তিনি বলেছিলেন যে, পাকিস্তানে শতবার লটারী জিতে যে টাকা পেয়েছিলেন তা দিয়ে তার বাড়ী ক্রয় করেন। পুলিশ তার পিছু নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় দায়ীত্ব মনে করেই এবং কোন ছাড় না দিয়েই তার চোরাকারবারী উৎসের সন্ধান বের করে। পরে তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তার পুরো টাকাটাই ছিল কালোবাজারী ব্যবসার। এ হলো বৃটেনে গড়ে তোলা পুলিশের নমুনা। এখানে কল্পনাই করা যায় না যে পুলিশ উপরি আয় করতে চাইবে।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কালোটাকা আর চোরাকারবারীদের আসলেই স্বর্গরাজ্য। গত দু’এক মাসের বাংলাদেশের খবর এমন ইংগিতই দেয়। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার খুব শক্তহাতেই এর মোকাবেলা করছেন। সবচেয়ে দেখার মত ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় ঘটনা হলো যে এবার নির্বাচিত সরকারই এসকল দুরাচারদের রেব-পুলিশ দিয়ে মোকাবেলা করছেন। সামরিক বাহিনীকে নামাতে হয়নি কিংবা সামরিক বাহিনী নিজে থেকে এমন ঘটনার মোকাবেলায় নামেনি। বরং সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ পিএসসি, জি(আর্টিলারি) সরকারের এমন পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। দূর্ণীতি দমনে তিনি সরকারের সফলতা কামনা করেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে নানারূপের ভয়াবহ দূর্ণীতি দমনে বঙ্গবন্ধু প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বেসামরিক সরকারের পক্ষ থেকে সামরিক বাহিনীকে দায়ীত্ব দিয়েছিলেন। অবশ্য তখনও দেশের পুলিশ বাহিনী তেমন সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠেনি। সবেমাত্র হাটি হাটি পা পা করে সামনের দিকে এগুচ্ছে। তাই সম্ভবতঃ বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু সামরিক বাহিনীকে অবস্থা মোকাবেলার জন্য মাঠে নামিয়েছিলেন। এটি কোন সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল না। সিভিল সরকার, সামরিক বাহিনীকে রাহুগ্রাসী দূর্ণীতি-দুরাচার দমনে মাঠে নামিয়েছিলেন।
কালোটাকার এ ব্যবসার সাথে কে যে জড়িত নয় তা খুঁজে বের করা বেশ একটি কঠিন কাজ। তবে এটা ঠিক বেআইনীভাবে সরকারকে কর ফাঁকী দিয়ে টাকার স্থানবদল ও হাতবদলের সাথে কিছু লোক যে সরাসরি জড়িত তা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। এবং তারা যে বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান তাও অস্বীকারের উপায় নেই। এদেরকে সরকার বা পুলিশ কেউই চেনেন না এমন মিথ্যা বলাও আর কিছুই হতে পারে না।
আমার প্রয়োজনে আমি টাকা পাঠাতে গিয়ে কারবারীর খোঁজ করি দু’টাকা বেশী গুণার জন্য। এরাও ব্যবসায়ী, তারা তাদের খদ্দেরকে সরকার নির্ধারিত বিনিময় মূল্যের চেয়ে একটু বেশী মূল্য পরিশোধ করে থাকে। এক্ষেত্রে যেকোন দেশের সরকারই হোক যদি বাজারে চলিত দাম দেখে অর্থের বিনিময়মূল্য ঠিক করে রাখেন এবং এসব কারবারীদের ব্যবসার সুযোগ করে দেন বিধিমত অধিকার দিয়ে তা’হলে অতি অবশ্যই টাকার কালোবাজারী কমে আসতে বাধ্য।
বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানে দূর্ণীতি নতুন কিছু নয়। সুদূর অতীতের ইংরেজ আমলেই এর বিষবৃক্ষ পোতা হয়েছিল। কিভাবে পোতা হয়েছিল তার সত্যতা খুঁজে দেখতে খুব বিশাল আকারের ভিনদেশী কিতাব পড়তে হবে না। খ্যাতিমান ছড়াকার প্রয়াত সুকুমার রায়ের ছড়া পড়লে এ কথার সত্যতার আসল খুঁজ পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছিলেন-
“সবে হল খাওয়া শুরু, শোন শোন আরো খায়
সুদ খায় মহাজনে ঘুষ খায় দারোগায়…”
মারা যাবার ১৩বছর আগে ১৭৯২সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জন্য পুলিশ রেগুলেশন জারী করেছিলেন। আবার “১৮৬১ সালে ইংরেজরা বৃটিশ ভারতে সরকারের কর্তৃত্বমূলক পুলিশের প্রবর্তন করেছিল।” এ পুলিশকে পরোক্ষভাবে শেখানো হয়েছিল বখরা খাওয়া বা উপরি আয়করা। তাদের নিজ দেশে এরও ৩২বছর আগে ১৮২৯ সালে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা ও চেতনা থেকে মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং বৃটিশ কনস্টেবুলারি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করেছিল। “একই বৃটিশ কর্তৃক পরিচালিত দুই দেশের পুলিশকে দুই ধরনের আইনের বলয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। একটু সচেতন হলেই এই দ্বিমুখী নীতির শুভঙ্করী ফাঁক খুব সহজেই যে কোন মানুষের কাছে ধরা পড়বে। এর মূল কারণ, অভিন্ন যুক্ত ভারতে ইংরেজ শাসকরা জনসেবা বা জনকল্যাণের মানসে পুলিশ বাহিনীর জন্ম দেয় নাই। পুলিশকে মূলত জনগণের শোষণ কাজে ব্যবহার করার জন্য বানানো হয়েছিল।” পরবর্তী সারা ভারতের ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয়। নিজ দেশে পুলিশকে কিন্তু ঠিকভাবেই তারা গড়ে তুলেছিল যার ফল হলো আজকের বৃটিশ পুলিশিং।
নির্দ্বিধায় এবং নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় যে, ১৭৫৭ সালের কূটকৌশলী পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া বিশাল ভারতকে ভালবেসে সেবাদানের মাধ্যমে এক সুন্দর দুনিয়াসেরা দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কোন ইংল্যান্ডবাসী এদেশে আসেনি। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পর ইংরেজদের মনে এ বিশ্বাস জন্মে যে, এদেশের মানুষকে দমিয়ে রেখে শাসন-শোষণ করতে হলে সাদা চামড়ার মানুষ দিয়ে সম্ভব নয়। একমাত্র “কৈ’র তেলে কৈ ভাঁজা” জাতীয় এমন একটা রাস্তা বের করতে হবে। আর সে চিন্তা থেকেই অস্ত্রধারী পুলিশবাহিনী তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা তারা মর্মে মর্মে উপলব্দি করেন। শুধু তাই নয় তারা আরও ভাবেন যে এদেশের শ্যামল রংয়ের মানুষ হয়েও যারা সাদা চামড়ার সাহেবদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবে এমন মানুষদের নিয়ে পুলিশ গড়ে তুলতে হবে। তাইতো আমরা দেখতে পাই
এদেশের অশিক্ষিত ও সবলদেহী যুবকদের নিয়ে তারা তৈরি করে এক খাকি-পোষাকের পুলিশ বাহিনী।”
“১৭৯২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জন্য পুলিশ রেগুলেশন জারী করলে জমিদারদের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী রাখার বিধান রহিত হয়। প্রত্যেক জেলা/পরগনাকে ৪০০ বর্গমাইলের কয়েকটি পুলিশ এলাকায় বিভক্ত করা হয় যা বর্তমানে থানা বলে পরিচিত। প্রত্যেক এলাকার নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন দারোগা নিয়োগ করা হতো। দারোগা নিয়োগের শর্ত ছিলো ৫০০ টাকা জামানত দিতে হবে চাকুরী নিতে। সে সময় অনুমান ৫০০ মন চাউল বিক্রি করে ৫০০ টাকা সংগ্রহ করতে হতো। তদুপরি দারোগাকে নিয়মিত বেতন দেয়া হতোনা। তাকে উদ্ধারকৃত চোরাই মালের এক দশমাংশ দেয়া হত। আর একজন ডাকাত গ্রেপ্তার করতে পারলে দশ টাকা পুরস্কার দেয়া হতো। তাই বাধ্য হয়ে দারোগা বাবু অসৎ উপায় অবলম্বন করে তার জামানতের টাকা উত্তোলন করতো। এই বখরা খাওয়ার যে প্রথা লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯২ সালে চালু করেছিলেন তা থেকে এখনও আধুনিক বাংলাদেশের পুলিশ মুক্ত হতে পারেনি। বৃটিশ সরকারের মতো পাক-বাংলার সরকারও মনে করতো, পুলিশের বেতন ভাতার দরকার নেই। আর বেতন ভাতা বেশী হলে বা ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন সংস্কার হলে পুলিশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তাদের কর্তৃত্ব বা অনৈতিক হুকুম তামিল করবেনা এই পুলিশ।
অতীতের দিকে একটু তাকালেই বুঝা যাবে বৃটিশদের পুলিশ ব্যবহারের নমুনা। ছিয়াত্তরের সেই বিশ্বখ্যাত দুর্ভিক্ষে বাংলার এক কোটির বেশী লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছিল। এতো ভয়ানক দুর্ভিক্ষ বিপর্যয়ের মাঝেও ইংরেজদের খাজনা আদায় এক কানা কড়িও কম ছিল না। নিঃস্ব কৃষককে টেনে হেঁচড়ে সাহেবের সামনে হাজির করা ছিল বাঙালী পুলিশের জন্য একটি ইশারার বিষয়। হালের গরু বলেন, ক্ষেতের ফসল বলেন আর ভুখা কৃষকের যুবতী মেয়ে বলেন… সব কিছুই খাকি পোষাকের পুলিশ জওয়ানরা একটি হুকুমের বলে সাহেবের সামনে হাজির করতো। কারণ পুলিশ হুকুম পালন করতে বাধ্যছিল। এরও কারণ ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনে নিম্ন পদস্থ কর্মচারীদেরকে ঊর্ধ্বতনদের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। যদিও বৃটিশ সরকার এখন আর নেই তবে তাদের প্রবর্তিত আইন রয়ে গেছে। সে আইনেই চলছে বর্তমান বাংলাদেশ পুলিশ।”
এতোসব লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশ পুলিশ এমন করবেই। তাদের বদলানো যাবে না। এ বিশ্বে এমন কিছু নেই যা বদলানো যায়নি। পুলিশের আইনী ধারার আমূল পরিবর্তন করে মানুষের সেবামুখী নিয়মনীতি নিয়ে আসতে হবে। এর বিকল্প অন্য কিছুই নেই। তথ্য সহায়তা-‘আমরা পুলিশ পরিবার’ |