মৌলভীবাজার থেকে আব্দুল ওয়াদুদ।। ফেলে আসা অতীতের কোন এক সময়ের ১০০ শয্যা হাসপাতালের পুরোনো ভবনটি স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খাওয়ায় নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন মৌলভীবাজারের সেই সময়ের সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এজন্য হাসপাতালের উন্নয়নে স্থানীয় বিভিন্ন মহলকে অনেক দৌড়ঝাপ দিতে হয়েছিল। এর পরই ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল বাস্তবে মানব সেবা দিতে নতুন এক রূপে ফিরে আসে।নির্মাণকাজের নতুন সাজসজ্জ্বায় ২০১২ সালের পয়লা ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের ২৫০ শয্যায় নবায়নের পর থেকে দিন দিন সাধারণ রোগীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। মানুষ, স্বাস্থ্য বিষয়ে আগের চেয়ে বেশী সচেতন হওয়ায় আর এই সাথে হাসপাতাল দালানের নবতর সাজসজ্জ্বায় মানুষের ভাল চিকিৎসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও স্বভাবতঃই বেড়ে যায়। তাই দেখা যায় বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য শত শত রোগী সাত সকালে লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকেন একটি টিকেটের জন্য। অধিক সজ্জ্বার সাথে নতুন ভবনের শুভ উদ্বোধন করেছিলেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্থানীয় হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সন্ধ্যায় প্রাইভেট ক্লিনিক অথবা চেম্বারে যেসকল চিকিৎকরা সেবা দিয়ে থাকেন তারা সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা দিতে আসেন। ফলে ইদানিং রোগীরা পুনঃ হাসপাতালমুখী হতে শুরু করেছেন। এই স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহও করা হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতাল সূত্র আরো জানান দিন দিন হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় বহিঃবিভাগে ২০১৩ সালে যেখানে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫শ ৪৮ জন রোগী তালিকাভুক্ত হয়েছিল সেখানে ২০১৪ সালে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭জন, ২০১৫ সালে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৯শ ৫৯জন, ২০১৬ সালে ২ লাখ ৭ হাজার ৯শ ১৭ এবং চলতি বছর ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫২ হাজার ১শ ২৬জন রোগীকে সেবা দেয়ার রেকর্ড তৈরী হয়েছে।
জরুরী বিভাগে গত ২০১৩ সালে ৫৭ হাজার ৫০জন, ২০১৪ সালে ৬৯ হাজার ৮শ ৭৭জন, ২০১৫ সালে ৭৮ হাজার ৯শ ৭৫জন, ২০১৬ সালে ৭৮ হাজার ৩৮০জন ও ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ২১ হাজার ২শ ১৭ জন রোগী চিকিৎসা সেবা নেন। এদিকে দিন দিন হাসপাতালে যেমন চিকিৎসা সেবা যেমন বাড়ছে তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে সরকারকে দেয়া রাজস্ব। সরকারি কোষাগারে ২০১৩ সালে দেয়া হয়েছে ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৪শ ৪২ টাকা, ২০১৪ সালে ৬১ লাখ ৬২ হাজার ৮শ ৬৯ টাকা, ২০১৫ সালে ৮৫ লাখ ২২ হাজার ৭শ ৬৯ টাকা, ২০১৬ সালে ৮৪ লাখ ৫৩ ৫শ ৬৮ টাকা ও চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩০ লাখ ৬ হাজার ৩শ ৬০ জমা দিয়েছে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতাল। সব মিলিয়ে চার বছরে ৩ কোটি ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮ টাকা সরকারি রাজস্বখাতে জমা পড়েছে।
রাজনগর উপজেলার শাহাপুর গ্রামের রাসনা ও রাজনা বেগম। এসেছিলেন হাসাপতালে শিশু বিশেষজ্ঞ-এর কাছে, ছেলে-মেয়ের চিকিৎসা নিতে। সরলপ্রান গ্রামের মানুষ! আলাপকালে মনখোলে দুই বোন বলেন- স্যারকে চেম্বারে প্রাইভেট দেখাতে হলে রাত অনেক হয়ে যাবে তাই দুপুরে এসে টিকেট কেটে বিনামূল্যে সেবা নিলাম।
২৫০ শয্যা হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী জানান, এই হাসপাতালের সেবা বৃদ্ধির জন্য নতুন আরেকটি এ্যাম্বুলেন্স সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়াও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আউট সোর্সিং ও স্থায়ী ২০জন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োজিত আছে। তিনি জানান, জটিল কিডনি রোগীর চাপ বেশী থাকায় এখন থেকে কিডনি রোগীদের প্রতিদিন দুবার চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাঃ পার্থ সারথি দত্ত কাননগো জানান, ২০১২ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হাসপাতালটির আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। হাসপাতালটির সেবার মান আরো বৃদ্ধির জন্য আমরা চেষ্ঠা করে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে তিনি আরো বলেন, আউটডোরে প্রতিদিন ৭শ থেকে ৮শ রোগী এসে সেবা নিয়ে যান। আমাদের গাইনী ও সার্জারী বিভাগে ২৪ ঘন্টা অপারেশনসহ দক্ষতার সাথে লেপারোস্কপিক সার্জারি ও অর্থপেটিক অপারেশন সম্পন্ন হয়।
অবশ্য তিনি কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে বলেন, চর্ম, যৌন ও চক্ষু বিভাগে বিশেষজ্ঞ পদ দুটি শুন্য রয়েছে। ওই দুটি বিভাগ পূর্ণ হলে সেবার মান বৃদ্ধিতে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে হাসপাতাল।
তিনি বলেন, আমাদের ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ১টি লিফট আছে যা দিয়ে রোগী বহন করা অসম্ভব। আরেকটি বৃদ্ধি হলে অনায়াসে উচু তলায় রোগীদের নেয়া যেতে পারে।
সবকিছু মিলিয়ে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতাল পর্যটন জেলার সকল মানুষের চিকিৎসা সেবায় আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারতো যদি হাসপাতালের পাশাপাশি একটি মেডিকেল কলেজ চালু করা হতো। একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় শর্ত এখানে বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও কেনো তা হচ্ছে না এ প্রশ্ন পুরো জেলাবাসীর। পুরো জেলাবাসীর দাবী মৌলভীবাজারে যেন একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়। মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষের জন্য সেবার একমাত্র ভরসা ২৫০শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতাল। শুধু জেলাবাসীই নয়, পর্যটন সম্ভাবনায় ভরপুর সীমান্ত জেলা মৌলভীবাজারে মেডিকেল কলেজ স্থাপন এখন সময়েরও দাবী বটে।