মৌলভীবাজার
বীর মুক্তিযোদ্বারা মরন পণ লড়াই করে পাক হানাদার বাহিনীকে মৌলভীবাজার থেকে বিতারিত করে শত্রুমুক্ত করেছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। তবে এর আগে হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করে নিহত হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্বাসহ অগণিত নারী-পুরুষ ও শিশু।
জানা যায়, ২৬মার্চের পর থেকে পাকিস্থান হানাদার বাহিনী ৬ ডিসেন্বর পর্যন্ত মৌলভীবাজারের নড়িয়া ও পাঁচগাঁও সহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা করেছিল কয়েকশত নিরীহ মানুষকে। শত শত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায়। মৌলভীবাজারকে হানাদার মুক্ত করতে শাহবন্দর, বাউরভাগ, আজমেরু, বাসুদেবশ্রী, কামালপুর, পৈলভাগ, গয়ঘর, নড়িয়া এলাকায় ব্যাপক অগ্নি সংযোগ নির্যাতন ও এলোপাতারি গুলিতে বীর লড়াকু স্বাধীনতাকামী তারামিয়া, জমির মিয়া, নীরোধ চন্দ্র রায়, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল মন্নান, উস্তার উল্লাহ ও ইপিআরের সদস্যসহ কয়েক শত নারী পুরুষ আবাল বৃদ্ধবনিতা শহীদ হন।
একাত্তরের ২৭মার্চ শহরের সামরিক প্রশাসনকে সশস্ত্র ঘেরাও করার লক্ষ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শহরের চার দিক থেকে ছাত্রজনতার সশস্ত্র(লাঠিসোটা) মিছিল নিয়ে এসে এসডিও ও সামরিক প্রসাশনকে ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত অনুসারে শহরের সরাসরি উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ছাত্র জনতার দু’টি দল শহর অভিমুখে অগ্রসর হয়। উত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামীদের মনু সেতুর উত্তর তীরে আটকিয়ে দেয় গণহত্যাকারী সামরিক বাহিনী গুলি বর্ষণ করে। এ সময় সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছুঁড়েছিলেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা প্রবাসী সজ্জাদুর রহমান। প্রত্যুত্তরে পাকসামরিক জান্তার মেশিনগানের গুলি পায়ে লেগে লেচু মিয়া মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। মেশিনগানের গুলি চালানোর ফলে লাঠিসোটাধারী অবরোধকারীরা পলায়ন করেন। অনেকটা ঠিক একই সময় পশ্চিম-উত্তর থেকে আসা লাঠিসোটাধারী মিছিলকে পেছন দিক থেকে পাক সামরিক জান্তা মেশিনগান দিয়ে আক্রমন করে ও গুলি চালায়। এ মিছিলের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ছাত্রনেতা গোলাম মওলা। এখানেই স্বাধীনতাকামী জমির মিয়া পাকসামরিক জান্তার মেশিনগানের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলেন।
এমন অবস্থায় ঘেরাও আন্দোলন যুদ্ধের রূপ নেয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বহুমূখী মরনপন লড়াই ও ভারতের সীমান্ত লগ্ন শহর সমশের নগরে পাকসামরিক বাহিনীর ৮-৯সদস্যের একটি দলকে মেশিনগান দিয়ে নিশ্চিন্ন করে দিলে ভারতীয় সাহায্যে মুক্তি বাহিনী ক্রমশ মৌলভীবাজার শহর অভিমুখে এগিয়ে আসার ধারনায় পাক বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক বুঝে পাকসামরিক জান্তা শহর থেকে পালিয়ে গিয়ে সাদিপুরে অবরোধ তৈরী করে। এ সময় স্বয়ংক্রীয়ভাবে মৌলভীবাজার মুক্ত হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময়ে শেরপুরে পাকসামরিকজান্তা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয় শেরপুরে। গুলির অভাবে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ থেকে সরে আসে এবং অবরোধ তুলে নিয়ে আকবরপুর রেষ্ট হাউসের পাহাড়ী খাদে নিরাপদ অবস্থান নেয়। এ সময়ই ব্যাপকহারে শুরু হয় ভারতে যাওয়া। শেরপুরের এই যুদ্ধে মৌলভীবাজার থেকে সক্রিয় অংশ নেন হারুনূর রশীদ ও আব্দুল মোহিত টুটু। টুটু এই যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। এর পর পাকজান্তা আবার মৌলভীবাজারকে দখলে নিয়ে নিয়েছিল।
এর বহুপরে মনুসেতু ও সোনালী ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে তারা পালিয়ে যায় এবং শেষবারের মত মুক্ত হয় মৌলভীবাজার শহর। উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মরহুম মির্জা আজিজ আহমদ বেগ মৌলভীবাজারের স্বাধীনবাংলার পতাকা উত্তোলন করেন এই ৬ ডিসেম্বর তারিখে। এর পরে ৮ই ডিসেম্বর তৎকালীন এমপিএ প্রয়াত আজিজুর রহমান ভারত থেকে ফেরৎ এসে আবারো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
বড়লেখা
৬ ডিসেম্বর, ২০২১। আজকের এ দিনে মৌভীবাজারের ৩টি উপজেলায় পাক সেনা শাসনের অবসান হয়েছিল। বলা হয়, ৬ ডিসেম্বর রবিবার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শত্রু মুক্ত হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, রাজনগর ও বড়লেখা উপজেলা।
বড়লেখা উপজেলা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখাবাসী জেগে উঠেছিল রণহুঙ্কারে। সেসময় প্রায় ৩২৫টি গ্রাম যেনো প্রতিরোধের এক একটি দুর্গে পরিণত হয়।
জানা গেছে, বড়লেখা থানাটি ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। সেসময় মেজর সি আর দত্ত সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। এ সেক্টরের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের করিমগঞ্জে প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে। বড়লেখা থানার পার্শ্ববর্তী বারপুঞ্জি ও কুকিরতল-এ সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। হানাদারদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ছোট বড় আক্রমণ চালিয়েছে এ সাব-সেক্টরের মুক্তি সেনারা। যুদ্ধের শুরুতেই বড়লেখার বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বড়লেখাবাসী।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নাকাল হানাদাররা বড়লেখা ছাড়তে বাধ্য হয়। ৬ ডিসেম্বর ভোরে বড়লেখা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। পরে বর্তমান উপজেলা পরিষদের সামনে এক বিজয় সমাবেশ করা হয়েছিল।
কুলাউড়া
৬ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানারও(বর্তমান উপজেলা) মুক্ত দিবস বলে জানা যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সাড়াঁশি অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে দখলদারিত্ব ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্ত হয় কুলাউড়া অঞ্চল। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
কুলাউড়া থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা বাগানে। নভেম্বরের শেষ দিকে গাজীপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এতে নেতৃত্ব দেন এম এ মোমিত আসুক। সাগরনাল চা বাগানে প্রথম এসে অবস্থান নেন তারা। ওই স্থানে মিলিত হন ধর্মনগর থেকে আগত কর্নেল হর দয়াল সিংহের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা বাহিনীর ৬৭ রাজপুত রেজিমেন্টের বিরাট একটি দল। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জব্বার, মনু মিয়া, আব্দুল মুকিত মিকিসহ মুক্তিযোদ্ধারা কুলাউড়া ডাকবাংলো মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কুলাউড়াকে মুক্ত ঘোষনা করেছিলেন।
রাজনগর
রাজনগর, ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজনগর উপজেলা পাকসেনাদের কবল থেকে মুক্ত হয়। যৌথবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল এমএ হামিদ প্রথমে লাল সবুজের বিজয় পতাকা উড়ান রাজনগরের ক্লাব প্রাঙ্গণে বলে জানা যায়। এর আগে উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের রাউবাড়ি এলাকায় রাজনগর বিজয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় এখানেই নির্মাণ করা হয় ‘শহীদ মিনার’।
৪ ডিসেম্বর ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মৌলভীবাজার হয়ে রাজনগর পৌঁছেন। তারা উদনা চা-বাগানে অবস্তানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেন। ৫ ডিসেম্বর প্রচণ্ড শীতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করেন উদনা চা-বাগানে এবং আক্রমণ করেন হানাদারদের ওপর। টানা যুদ্ধের পর ৬ ডিসেম্বর ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে শুরু করে এবং এদিনে শত্রুমুক্ত হয় রাজনগর।
শ্রীমঙ্গল
১৯৭১ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য আলতাফুর রহমান, কমান্ডার মানিক ও ফরিদ আহম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গলে গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সেদিন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল এ অঞ্চলের চা-শ্রমিকরা।
২৩ মার্চ শ্রীমঙ্গল পৌরসভার সামনে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমেই শ্রীমঙ্গলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমল লড়াই শুরু করেন তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে এদিনে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে পৌরসভা চত্বরে পুঃনরায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাগন।
ঢাকা প্রতিদিন-২০২০সালের ৭ডিসেম্বর সংখ্যা, ‘সিলেট টুডে২৪’, আমাদের সময়.কম ও ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলানিউজ২৪-এ প্রকাশিত তথ্য অবলম্বনে লিখেছেন সৈয়দ বয়তুল আলী।
|