হারুনূর রশীদ।। রহস্যময় মানব জনমের ইতি ঘটিয়ে চির অচেনা-অজানার ঠিকানায় চলে গেলো আব্দুল জলিল। এই মাসখানেক আগে তার সাথে ফোনে আলাপ হয়েছিল। এমনিতেই ভাল-মন্দ সাধারণ আলাপ। মৌলভীবাজারের সর্বজন প্রিয় তারেক আহমদের মৃত্যু সংবাদ জলিলই প্রথম আমাকে দিয়েছিল। টেলিফোনের আলাপে সেদিনই প্রথম অনুভব করেছিলাম জলিলের বন্ধুভাব কত গভীরের ছিল। খুবই আন্তরিকতার সাথে তারেকের খবরটি লিখে প্রকাশ করার অনুরোধের ভাষা আমৃত্যু আমার মনে থাকবে। আজ তারেকও নেই জলিলও চলে গেলো।
গতকাল নিউইয়র্ক সময় অনুমান রাত ১১-৩০মিনিটে মেনহাটনের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে জলিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬বছর। জলিলেরা ভাই-বোন ৩জন। জলিলের কোন ভাই নেই ২বোন আছেন আমেরিকায়ই। তাদেরকে জলিলই আমেরিকায় নিয়েছেন। মৃত্যুকালে জলিল স্ত্রী সাফিয়া বেগম ১ছেলে ও ২মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন। নিউইয়র্কের বাঙ্গালী সমাজ বিশেষকরে মৌলভীবাজারের মানুষজনের মাঝে জলিলের পরিচিত ছিল আকাশচুম্বি। জলিল নামটি সকলের কাছে ছিল সুপরিচিত।
জলিলের সাথে আমার সম্পর্ক সেই স্কুল জমানা থেকে। জলিল, মৌলভীবাজার ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরের সদস্য ছিলো। এ ছাড়াও মৌলভীবাজারের পরিসরে জলিল নিজেকে জাসদ রাজনীতির ভেতর দিয়ে গড়ে তোলেন। ট্রাভেলস ব্যবসার হাতেখড়ি নিয়ে জলিল মৌলভীবাজারের ব্যবসা অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তার পর তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সত্য তবে পাহাড় কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে তাকে চলতে হয়েছে। সেই সময়ে ঢাকার নামকরা ‘জেটসেট ট্রাভেলস'(দারোগার ট্রাভেলস নামে সমধিক সুপরিচিত ছিল)এর সাথে জলিলের ব্যবসা ছিল। ব্যবসায় যেমন আয় হয়েছে বন্ধুবৎসল জলিলের ব্যয়ও ছিল তেমনি হাতি পোষার মত। এ ছাড়াও জলিল আমার ছোটভাই প্রয়াত কয়ছর রশীদ পিরুনের সহপাঠী ছিল। পিরুন ১৯৮৩সালে লণ্ডনে এক মোটর দূর্ঘটনায় প্রয়াত হয়। সবকিছু মিলে জলিলের সাথে আমার এক গভীর মমত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমার সৎ মা ও ভাই-বোনদের লণ্ডন আসার কাজে জলিল আমাকে যারপর নাই সহায়তা করেছে যার কোন মূল্য হিসেব করা যায় না। এমনই ছিল জলিলের উদার মন। বিদেশের কঠিণ পাথুরে জীবনের বাস্তবতায় গিয়েও জলিল বদলায়নি।
একসময় অন্য এক ঘটনায় বন্ধুত্বের দায় সারাতে গিয়ে জলিলকে বাংলাদেশে অবস্থান করতে হয় সুদীর্ঘ বছর খানেকের মত। তখন তিনি ঢাকার ‘মেনহাটন’ হোটেল এণ্ড রেস্তোরাঁর দালান নির্মাণ থেকে শুরু করে ব্যবসা শুরু পর্যন্ত বন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে এসে কাজ করেছেন। নিজের জন্য সময়, শারিরীক সুস্থতা বা ব্যক্তিনিরাপত্তার বিষয়ে ভ্রুক্ষেপই করেনি। নাটক ও সংস্কৃতির প্রতি জলিলের ছিল মনের গভীর টান। স্বাধীনতা পরবর্তী সেই একাত্তুর থেকে শুরু করে ছিয়াত্তুর সাতাত্তুর সাল অবদি বহু কাল জলিলকে দেখেছি নিবেদিতপ্রান এক শিল্পকর্মী হিসেবে। শিল্পী হিসেবে নাটক প্রেমিক জলিলকে সে সময় দেখেছি মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে। আমার ও প্রয়াত ইকবাল ভাইয়ের পরিচালনায় মৌলভীবাজারের তৎকালীন কাশীনাথ ও আলাউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক প্রয়াত ব্রজেন্দ্র নাথ অর্জুন রচিত ‘পলাশি’ নাটকে জলিলের অভিনয় আজো ভুলার নয়। এর পর ‘কোহিনূর’ ও ‘একমুঠো ভাত’ নাটকে জলিলের অভিনয় এ মূহুর্তে দেদিপ্যমান হয়ে চোখের সামনে ভাসছে।
জলিল দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু এই অসুস্থতা নিয়েও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাকে সমানতালে পাওয়া যেতো বলে তার অনেক বন্ধু-বান্ধবের বাকরুদ্ধ কন্ঠের স্বীকারোক্তি। জলিলদের বাড়ী মৌলভীবাজার শহর সংলগ্ন হিলালপুর মৌজায়। ফকরুল ইসলাস ফকরু জলিলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জলিল ফকরুকে চাচা বলে সম্বোধন করতেন। সেই ফকরুই আজ মঙ্গলবার ৩রা ডিসেম্বর সকালে ফোন করে আমাকে তার অন্তর্ধানের খবর দেয়। কথা প্রসঙ্গে এক সময়ের নামি-ডাকি ফুটবলার ফকরুর কাছে জানতে চাইলাম জলিলের উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি তার বলার আছে কি-না। ফকরু বললেন, সারা জুগিঢর এলাকায় অনেকের মাঝে আমিই ছিলাম জলিলের একমাত্র প্রানের সুহৃদ। সে আমাকে খুবই বিশ্বাস করতো আর তাই চাচা বলে সম্বোধন করতো। কত স্মৃতি তাকে নিয়ে। স্মৃতিতো মন থেকে সরাতেই পারছিনা। হয়তোবা আমৃত্যু তার স্মৃতি বহন করেই আমাকে একসময় দুনিয়া থেকে বিদেয় নিতে হবে। তার অনেক কিছুইতো আপনি নিজেও জানেন। ফোনে আলাপ করতে গিয়ে ফকরুর কন্ঠ ধরে গিয়ে আঢ়ষ্ট হয়ে উঠছে আমি বুঝতে পারি। কথা আর বাড়াইনি। জলিলের উদ্দেশ্যে শুধু বলেছি- যেখানে থাকিস ভাই হাসি-খুশীমনে ভালই থাকবি, আমাদের সকলের কামনাও তাই।