আব্দুল ওয়াদুদ।। চায়ের রাজধানী, পর্যটন জেলা ও হাওর-বাওর অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলা। এ জেলার যেদিকে চোখ যায়, সবুজ আর অপরূপ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হন দেশ বিদেশ থেকে আশা অগনিত প্রকৃতি প্রেমীগন। জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরের একটি জলমহাল, নাম বাইক্কা বিল। বিলটিকে গেল ক’বছর আগে বাংলাদেশ সরকার অতিথি পাখি ও মাছের অভয় আশ্রম হিসেবে ঘোষনা করেন। প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের এ যায়গাটিকে ভিন দেশী পাখিরা তাদের নিরাপদ আশ্রয় ভেবে ফি বছরই আবাস্থল গড়ে তুলে। এমন অনেক পাখী আছে যারা স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে। গভীর শীতে একটুখানি উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে ও পূর্ণরূপে খাদ্যের তাগিদে ২ থেকে ৩ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ডানা মেলে পৃথিবীর দক্ষিনাঞ্চলের সাইবেরিয়া, মঙ্গলিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশীয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে উড়ে এসে, ভর করে যখন মধ্য এশিয়ার বাংলাদেশে তখন দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও হাইল হাওর অধ্যুষিত চির-চেনা বাইক্কা বিলে মেলা জমায় আর মনের সুখে বিচরণ করে বিলের চারপাশে।
তাদের উড়ে চলার ভাব-ভঙ্গি এক নজর দেখে মনে হবে, বাইক্কা বিলটি যেন তাদের জনম-জনম চেনা। শীত মৌসুমের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত বিলটিতে পুরোদমে চলে এসব অতিথিদের আনা-গোনা। সকাল কিংবা বিকেলে বিল পাড়ের ওয়াচ টাওয়ারে গেলে এদের কিচির-মিচির আওয়াজ, ঝাঁপ মেরে জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরে খাওয়া ও পাশের হিজল বনে ডানা মেলে সারি সারি বসার চিত্র দেখে অবিভুত হন পাখি প্রেমীরা। অনেকে নৌকা বেয়ে আবার কেউ ওয়াচ টাওয়ার থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে এসব অতিথিদের কাছে ঠেনে নিজেদের প্রফুল্ল রাখেন। এই লগ্নে খোলা আকাশ, বাতাসের ঝংকার আর জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভিন দেশী অতিথিরাও তাল দেয় তাদের মত করে। আর এতে এক প্রশান্তির সূরে সূরে পুরো বিল জুড়ে এক অন্যরকম আওয়াজ কাজ করে যা শিল্পমাধু্র্য্যে থাকে ভরা।
উল্যেখযোগ্য পাখিদের মধ্যে এবার বাইক্কা বিলে এসেছে সৈকতপাখি, খয়রা কাস্তেচরা, বড় পানকৌড়ি, পাতি-কুট, গিয়িরা হাঁস, তিলা হাঁস, পিয়াং হাঁস প্রভৃতি।
পাখি গবেষকরা জানিয়েছেন, পৌষের আগেই বিলটিতে পরিযায়ী পাখি এসে মধ্য ফাল্গুনের আগেই নিজ দেশে ঝাঁক বেধে যাত্রা করে। ২০১১ সালে “বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের” উদ্যোগে বাইক্কা বিলে পাখি গবেষণায় প্রথমবারের মতো পাওয়া গিয়েছিল বিশ্বের অত্যন্ত সংকটাপন্ন প্রজাতির পাখি ‘বড় ঠোঁট ফুটকি’। ২০০১ সালে এ প্রজাতির দুটি পাখি থাইল্যান্ডে দেখা গেছে। এর এক দশক পর বাংলাদেশের বাইক্কা বিলে একটি ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এ প্রজাতির পাখি দেখা যায়নি। ২০০৩ সালে ইউএসআইডি’র অর্থায়নে মাচ্ প্রকল্প ১০০ হেক্টর আয়তনের এ বিলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেই থেকেই কড়া নজরদারিতে এ বিলটি মাছ ও নিরাপদ অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে ওঠে। এছাড়াও পর্যটকদের সেবা দিতে বাইক্কা বিলে সরকারি তরফ থেকে একটি অফিস ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুকুলে না থাকায় পর্যটকরা পড়েছেন মহা বিপাকে। মৌলভীবাজার শহর থেকে মাত্র প্রায় ২০ কিলোমিটার ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্ব বাইক্কা বিল। মৌলভীবাজার- শ্রীমঙ্গল সড়ক থেকে বরুণা হয়ে বাইক্কা বিলে যেতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পর্যটক জানান, বরুণা থেকে বিল পাড়ের ৫ থেকে ৬ কিলোমটির সড়কের অবস্থা একেবারে নাজেহাল। অল্প যায়গা সংস্কারের নামে ফেলে রাখা হয়েছে। সড়কটি দেখে মনে হয় এক যুগ ধরে কোন সংস্কারই হয়নি। মাইক্রোবাসে করে ৫ কিলোমিটার সড়ক পাড় হওয়া একেবারে দুস্কর। ওই ৫ কিলোমিটার আমাদের পায়ে হেটেই যেতে হয়। সড়কটি পুরোদমে সংস্কার করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন পর্যটকেরা। তবে, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, বাইক্কা বিল সড়কটি টেন্ডার হয়েছে, কাজ ও চলছে।