সুরঞ্জিত দাস মহাভারতের প্রধান চরিত্র গুলোর একটি হচ্ছে, গান্ধারী। বহু গুণে গুণান্বিত গান্ধারীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি গান্ধার-রাজ সুবলের কন্যা, জন্মান্ধ কৌরব-রাজ ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী এবং গান্ধার যুবরাজ শকুনির (দুর্যোধন এর মামা) বোন। প্রতাপশালী হস্তিনাপুর রাজ্যের জন্মান্ধ যুবরাজ এর নিকট শতপুত্রের বরদান-প্রাপ্ত সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া, গান্ধার-রাজ সুবলের উপায় ছিল না। কিন্তু যুবরাজ শকুনি এটা মেনে নিতে পারেন নি, বোনের সাথে হওয়া এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার পণ করেন তিনি। কূটচালে পারদর্শী শকুনি একটি পারিবারিক বিরোধকে মহাযুদ্ধে (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ) রুপদান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের শেষের দিকে, পুত্রশোকে মুহ্যমান গান্ধারী, ভ্রাতা শকুনিকে দোষারোপ করেন এবং অভিশাপ দেন; শকুনি ও তার রাজ্য কোনদিন শান্তিতে থাকতে পারবে না। আজকের বিষয় গান্ধারী বা মহাভারত নয়, বরং গান্ধার রাজ্য বলা চলে। প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের অবস্থান ছিল বর্তমান আফগানিস্তানের উওর-পূর্বাঞ্চল এবং পাকিস্তানের কিয়দংশ নিয়ে। গান্ধার রাজ্যের সর্বশেষ রাজা ছিলেন পুস্করাশক্তি, যিনি পার্সিয়ান সম্রাট দারিয়ুস-১ কর্তৃক ৫১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পদচ্যুত হওয়ার মাধ্যমে গান্ধার রাজ্যের পতন ঘটে। আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার একটি স্থল বেষ্টিত, রুক্ষ-শুষ্ক পাথুরে পার্বত্য দেশ। ভৌগোলিক কারণে প্রাচীনকাল থেকেই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আরব দেশ সমূহের সাথে ভারতবর্ষ এবং চীনের স্থল পথে যোগাযোগের প্রধান রাস্তা হচ্ছে আফগানিস্তান। সহজ কথায়, আফগানিস্তান হচ্ছে চীন এবং ভারতের প্রবেশদ্বার। মুহাম্মদ বিন কাসিম থেকে শুরু করে বাবর, সবাই এই আফগানিস্তান হয়েই ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। আবার চীনের বিখ্যাত সেই প্রাচীন সিল্ক রোড এই দেশের উপর দিয়েই গিয়েছে। সুতরাং প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা সৌন্দর্য নয়, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় দেশটির রাজনৈতিক গুরুত্ব সবসময় ছিল, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আফগানিস্তানকে বলা হয় “Graveyard of Empires” অর্থাৎ সাম্রাজ্যের কবরস্থান। কোন বিদেশি শক্তি এখানে বেশিদিন টিকতে পারে না, আসলে টিকে থাকতে দেওয়া না। খ্রীস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে দারিয়ুস-৩ কে পরাজয়ের মাধ্যমে মেসিডোনিয়ান মহাবীর আলেকজান্ডার, দেবতাদের উত্তরসূরী দাবিকারী পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের পতন ঘটান এই আফগানিস্তানে। আবার আলেকজান্ডারের বিজয় রথও থেমে যায় এই রুক্ষ প্রান্তরেই। তিনি ফিরে যেতে পারেননি তার নিজ দেশে, আফগানিস্তান বিজয় করে ফেরার পথে তার মৃত্যু হয় পার্শ্ববর্তী দেশ ইরানে। এদিকে, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার মনোনীত রাজা সিলিকাস অত্র অঞ্চলের শাসনভার নিয়েছিলেন কিন্তু খ্রীস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে ভারতীয় মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে, এতদ্বঃ অঞ্চলে মেসিডোনিয়ান সাম্রাজ্যের কবর হয় এবং মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। তৎপরবর্তীকালে, গ্রিক, কুশান, হেফথালিট, মামলুক, ঘুরি, খিলজি, মুঘল, হটাক, দুররানি এমন অনেক সাম্রাজ্যের সলিল সমাধি হয়েছে আফগানের এই শুষ্ক মাঠিতে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ-সোভিয়েত রাশিয়া আধিপত্যবাদের “বৃহৎ খেলা বা Great Game” এর প্রধান চারণভূমিতে পরিনত এই দেশটি। বিগত একশ বছরে বিশ্বের প্রধান তিনটি পরাশক্তির মোকাবিলা করতে হয় আফগানদের। প্রথমে ব্রিটিশ, তারপর সোভিয়েত রাশিয়া এবং সর্বশেষ আমেরিকা। সব পরাশক্তিরই পতন ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে এখানে, কিন্তু প্রতিবারই এক নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে অন্য নাগপাশে ফেঁসে গেছে এদেশের মানুষ গুলো। বিশ্ব রাজনীতির খেলার পুতুল এ দেশ, কখনো হয়েছে বাফার স্টেট, কখনো প্রোক্সি যুদ্ধকেন্দ্র, কখনোবা সন্ত্রাসবাদের তীর্থস্থান। এখানে আরব- তুর্কীদের শাণিত তরবারি রক্তাক্ত হয়েছে বারংবার, এখানেই চেঙ্গিস খানের ঘোড়া আকাশে ধুলোর মেঘ তৈরি করেছে। এই জমিন দিয়েই তুর্কী-মুঘলরা তলোয়ার উঁচিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। এই সেই কাবুল নদী, যে জানে কত শত জ্ঞান ভান্ডার (বই) ছুড়ে ফেলা হয়েছিল তার বুকে, আরো কত শত ছাই হয়ে মিশে গেছে শুষ্ক মরুভূমিতে। এখানে মন্দিরের ঈশ্বর পরিবর্তন হয়েছেন সময়ে সময়ে, এখানেই জরাথুস্ত্রীয়বাদের অগ্নিশিখা আকাশ ছুঁয়েছে, হিন্দুদের অসংখ্য পৌরাণিক চরিত্র নির্মাণ হয়েছে, দীর্ঘ দিবস-রজনী বৌদ্ধরা শান্তির বানী শুনিয়েছে, দিগন্তে ইসলামের পতাকা পতপত করে উড়েছে। রাজা আসে রাজা যায়, হিন্দুকুশ পর্বতমালা আজও স্বাক্ষ্য দেয়, আফগানিস্তানের পাথুরে মাঠি আরো কর্কশ হয়, কিন্তু শান্তি আসে না মানুষের জীবনে। জ্ঞান বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করে বিশ্বের মানুষ যখন শান্তি, মানবতা আর উন্নতির জয়গান করছে, সেখানে আফগানিস্তান আজও গান্ধারীর সেই অভিশাপকেই বয়ে বেড়াচ্ছে…? ১৯ আগস্ট ২০২১, ৯:৪৯ সকাল |