মৌলভীবাজারে দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি, হাইল হাওর ও কাউয়াদীঘি হাওরসহ ছোট-বড় বহু হাওর-বাওর রয়েছে। এসব হাওরের প্রায় ৩শ বিল থেকে মৎস আহরণ করে দেশের সিংহভাগ মানুষের অভাব মেঠানো হয়। কিন্তু অসৎ ইজারাদারদের কারণে দিন দিন বিল থেকে বহু জাতের দেশীয় মৎস গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এসব ইজারাদাররা বিল সেচ করে একেবারে মাছের ডিম পর্যন্ত আহরণ করে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এমন কর্মকান্ডে প্রশাসনের উল্যেখযোগ্য ভূমিকা না থাকায় নানা প্রশ্ন তুলেছেন হাওর পাড়ের সাধারণ মানুষেরা।
‘জাল যার জলা তার’
এ ছাড়া ‘জাল যার জলা তার’ সরকারি এসব নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে বেশি লাভের আশায় মৎস্যজীবি ছাড়াও অন্য শ্রেণী-পেশার মানুষও এখন বিল ইজারা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। এ কারণে অনেক মৎসজীবি তাদের এই আদী ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজারের বৃহৎ এই ৩টি হাওরসহ প্রায় ১২ হাজার ৩৭৪ হেক্টর জমি জুড়ে ছোট বড় ২৯২টি বিল রয়েছে। এসব হাওরের প্রায় অধিকাংশ বিলে আইনের তোয়াক্কা না করে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের মধ্যে ইচ্ছে মাফিক জাল টেনে মাছ ধরা হয়। শুধু তাই নয়, অধিক মুনাফার আশায় তারা মেশিন দিয়ে পানি সেচে বিলের তলার কাঁদা পযন্ত বের করে নেয়। তলা থেকে ছোট প্রজাতীর দেশীয় মাছ আহরণ করে বাজারজাত করা হয়। এতে জেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতীর মাছ।
দেশের সিংহভাগ মানুষের মাছের চাহিদা মেটাতে মৌলভীবাজারের এসব হাওর-বাওর থেকে মৎস্য আহরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ১৯৮৫ সালের মৎস্য অধিদপ্তরের এক জরিপে হাকালুকি হাওরের ২৩৮টি বিলের মধ্যে ১২০ প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেলেও এ পর্যন্ত ৩২ প্রজাতীর মাছ আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছেনা।
অচিরেই বন্ধ করতে হবে এই অবাধ মৎস নিধন
হাকালুকি হাওরে ৪হাজার ৪শ হেক্টর জমি জুড়ে মোট ২৩৮টি বিল রয়েছে। উল্যেখযোগ্য বিলের মধ্যে রয়েছে, চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুলা বিল, পিংলারকোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, বারজালা বিল, পারজালাবিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল। মৌলভীবাজার সদর উপজেলা, শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হাইল হাওরে ১ হাজার ৪শ হেক্টর জায়গা জুড়ে ১৩টি বিল রয়েছে। এসব ইজারাকৃত বিল শুকিয়ে হর-হামেশা মাছ নিধন করা হয়। বৈশাখ মাসে বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে মাছেরা নতুন জলে ডিম ফুটিয়ে বংশ বিস্তার করে। কিন্তু বিল সেচে নিধন করায় গেল কয়েক বছর ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছেনা প্রবাদ প্রসিদ্ধ “মাছে-ভাতে বাঙ্গালীর” শ্রেষ্ট সম্পদ মৎস। বরং হারিয়ে যাচ্ছে বহু প্রজাতির মাছ।
মাছখেকোদের হাত থেকে পোনা মাছগুলোও বাঁচতে পারেনা
এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে ইজারাদারদের বিলে মৎস উৎপাদন ও আহরণের পুরো নীতিমালা ও শর্ত দেয়া হলেও এসব শর্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অধিক মুনাফার আশায় মাছ লুঠে ব্যস্ত থাকেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাউয়াদীঘি হাওর পাড়ের রাজনগর উপজেলাধীন ফতেপুর ইউনিয়নের শাহাপুর গ্রামের এক ব্যবসায়ী জানান, উপর খানাকি, ঘাকটি, কাপনিয়া, চাতল, আওয়া, ভুবানাকা, আরইয়ুন, উপরগোয়ালী, মাটিখুড়া, খাসরঢর, মাজরবান্দ, উলাউলি, চডুয়ারজাওর, গোলাইয়াসহ হাওরের বহু বিলে শর্ত উপেক্ষা করে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ২/৩ বার করে সেচ করা হয়েছে। তাদের হাত থেকে পোনা মাছগুলো বাঁচতে পারেনি।
এখনই আইনী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’র(বাপা) জাতীয় পরিষদ সদস্য আ,স,ম সালেহ সোহেল বলেন, বিলে মেশিন লাগিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নষ্ট করা হচ্ছে। এ কারণে মাছের খাদ্যে ঘাটতে দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, “জলা যার মাছ তার” এ নিয়ম না মানায় জেলে সম্প্রদায়েরা মৎস আহরণ করা থেকে ছিটকে পড়ছে। অন্য সম্প্রাদায় বিল ইজারা থেকে সরে দাড়ালে মৎসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কাজেই এদের বিরুদ্ধে এখনই আইনী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মোঃ আব্দুল হক শনিবার বিকেলে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, আমাদের শর্তে বলা হয়েছে, বিল শুকিয়ে মাছ ধরা যাবে না। কেউ যদি এমনটা করে তবে, চুক্তি বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।