লণ্ডন অফিস থেকে হারুনূর রশীদ।। সত্যিকারের ভালবাসা বড়ই নির্মম আর বেদনাদায়ক। বিভিন্ন কারণেই এই নির্মমতা জন্ম নেয়, প্রকাশও পায়। তাকে লুকিয়ে রাখা যায় না। সাধারণতঃ দু’টি মনের ভালবাসায় চির ধরে যদি কোন একটি মন বিরূপ হয়ে উঠে। চরম বেদনাদায়ক এমনকি আত্মঘাতি হয়ে উঠে যদি সমাজ বা পরিবার সে ভালবাসাকে ফিরিয়ে দেয় বা মেনে না নেয়!
নাট্য শিল্পী জামাল আহমদ। অত্যন্ত স্বচ্ছ ও শক্ত মনের অধিকারী। সত্তুর দশকে মৌলভীবাজার শহরের মঞ্চোজ্জ্বল শিল্পী। নাটকে অভিনয় করতেন। নাটক তিনি নিজে লিখেছেন ও বহু নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। এই শিল্পীর জীবনেও ভালবাসা, প্রণয় আর বিষাদের সিন্ধুসম আঘাত ও বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। এক দূর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে শিল্পী তখন শয্যাসায়ী। পরিবার থেকে তার সেবা শুশ্রূষার জন্য একজন বিশ্বস্ত সেবীকা নিয়োগ করা হয়। মায়াবতী সে সেবীকার সেবা শুশ্রূষার গুণে ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। দীর্ঘ দিনের সেই সেবার ফাঁকে যে ওই মায়াবতী তার মনজগতে বাসা বেঁধে নিয়েছেন তিনি বুঝতে পারেন। সেবার সেই পরিচয় পরিণত হয় পরিণয়ে।
কিন্তু বাধ সাধেন পরিবার। কোনভাবেই তাদের এ ভালবাসাকে গ্রহন করে নিতে নারাজ। জামালের শিল্পীমন বিদ্রুহী হয়ে উঠে। তার মনে তখন তিক্ত জিজ্ঞাসা। যে মানুষটি আমাকে এতো মমতায় ও সেবা শুশ্রূষায় সারিয়ে তুললো সেইতো হতে পারে সত্যিকারের জীবন সঙ্গী। সেইতো আমার সত্যিকার বিনোদিনী। বিনোদিনী রাইকে ছেড়ে আমি বাঁচবো কি করে? সাধনার অনুশীলনে ব্রতী যুবকশিল্পীমনের কঠিণ প্রশ্ন? পরিবার কেনো মেনে নেবেনা? যে পরিবার আমার মনের মানুষকে গ্রহন করতে পারে না, সে পারিবারিক বন্ধন দিয়ে আমার কি হবে!
আসে মনের বিপ্লব! মাত্র যৌবনে উপনীত তেজী সাহসী শিল্পীমন। মনের বিপ্লবে বিজয়ী হন জামাল। স্ত্রী হিসেবে সেই সেবীকাকে গ্রহন করেন। এই যুবক বয়সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের জীবনকে হাসিমুখে বরণ করে নেন এই শিল্পী। নিরীহ অবলা রাই জীবন সঙ্গীকে নিয়ে এক ভাসমান জীবনে চলতে থাকেন। এতো দুঃখকষ্টেও কোন দিন অতৃপ্ত দেখিনি দু’জনকে। শিল্পী জামাল আমার নির্দেশনায় মঞ্চস্থ বেশ কিছু নাটকের শিল্পী ছিলেন। তিনি সামাজিক এক সম্পর্কে আমার ভাইপোও ছিলেন। তাই তাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার আমার সুযোগ হয়েছিল। একজন শিল্পীর বেদনা বিধুর জীবন আমি দেখেছি অনেকটা কাছে থেকে। তাকে যতই দেখতাম বিস্মিত হতাম আর ভাবতাম আসল শিল্পীমনের মানুষ এমনই হয়। তার অন্তর্ধানের ক্ষনে জেনেও কিছু না লিখা এক ধরনের হটকারিতা মনে করি। তাই যা জানি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানার তাগিদে এবং তার বিয়োগ বেদনায় কাতর হয়ে এ লাইনটুকু লিখতে গিয়েছি। এতে কারো কোন মনোকষ্টের কারণ হলে নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন বলেই আশারাখি।
জীবনচক্র থিয়েটারের সাখাওয়াৎ লিটনের ফেইচবুকে দেখলাম তিনি লিখেছেন -“না ফেরার দেশে চলে গেলেন নাট্যকার, নির্দেশক শ্রদ্ধেয় আহম্মদ জামাল ভাই। শনিবার ঈদের দিন আনুমানিক সময় দুপুর ২:০০টার দিকে নবীগঞ্জে তার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেছেন। নাট্য জীবনে তার কয়েকটি নির্দেশনা এখনো আমাকে পথ দেখায়। জামাল ভাই আজীবন মনে রাখবো তোমার দেয়া সেই জীবন পথ। তুমি অপারে ভালো থেক উনার মৃত্যুতে আমি/আমরা জীবনচক্র থিয়েটার মৌলভীবাজার গভীরভাবে শোকাহত । আমরা ওনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ্ মরহুমের আত্নার হেফাজত করুন এবং উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। (আমিন)।”
সাখাওয়াৎ লিটন, দুনিয়ার শতকোটী মানুষের মহা আনন্দের বারতা নিয়ে যে ঈদ আসে সেই মহাখুশীর দিনে তার প্রয়াণ, তার বিশুদ্ধ আত্মা ও শক্ত সুন্দর মনেরই জানান দেয়। তোমাদের সকলের সাথে আমিও তার অজানা অনন্তযাত্রা শান্তিময় হোক, ফুলে ফুলে ভরে উঠুক! এ কামনাই করছি।