আব্দুল ওয়াদুদ, মৌলভীবাজার।। দেশীয় প্রবাদে আছে- “মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে”। সম্প্রতি পৌষের জাকুনীতে এখন সেই মাঘ মাসও পাল্টে গিয়ে সেই যায়গা দখল করেছে এখন পৌষ। পৌষের গেল ক’দিন ধরে মৌলভীবাজারে হঠাৎ বেড়েছে শীতের প্রকোপ। এই শীতে যেন মানুষের পাশাপাশি বনের বাঘও কাঁপছে।
প্রচন্ড ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় বিপাকে পড়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। চরম দুর্ভোগে পড়েছে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী ও নদী পাড়ের জেলেরা। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগবালাইও। এই জেঁকে বসা শীতের প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন চায়ের রাজধানীখ্যাত মৌলভীবাজারের চা শ্রমিকসহ বিপর্যস্ত কুশিয়ারা নদী ও হাওর পাড়ের মানুষ। এর আগে গত চৈত্র মাস থেকে ঠানা ৮ মাসের দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় হাওর ও নদী পাড়ের অসহায় ও মধ্যবিত্তরা সব খুইয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। এখন নগদ অর্থ কানা-করিও নেই যে, শীতবস্ত্র কিনে মোকাবেলা করবেন শীতের প্রকোপ।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, জেলার উপর দিয়ে গত কয়েক দিন থেকে বইছে হিমেল হাওয়া। জেলার তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি থেকে নেমে সর্বনিম্ন ৫.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আসে। এর আগে তীব্র এই বয়ে চলা শীতের রেকর্ড দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে রেখেছিল পর্যটন ও পাহাড়ী জেলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা। সেই সময়ে পাহাড়-টিলায় ঘেরা এই এলাকায় ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তাপমাত্রা ছিল ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গেল কদিন থেকে পুরোটা দিনেই যেন দেখা মিলছে না সূর্যের আলোর। হঠাৎ দুপুরে যখন সূর্য তার মিষ্টি কীরণ মাটিতে ছড়িয়ে দেয় তখন যেন “মেঘ না চাইতে বৃষ্টি” এরকম মৃদু তাপদাহ গ্রহন করেন জেলা শহরসহ পুরো সাত উপজেলার মানুষ। ক্ষনিকের মধ্যে আবারো সেই রোদেলা আলো নিভে গেলে শীতের তেজ যেন যেই সেই। এদিকে কুয়াশায় দিনের বেলার ব্যস্থ সড়কে যানবাহনগুলো চলে লাইট জ্বালিয়ে। এ অবস্থায় এ জেলার নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
মৌলভীবাজার শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের ফুটপাতে গোলাম নবী নামে রংপুর থেকে আসা শীতের বস্ত্র ব্যবসায়ীর দোকানে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গেলে দেখা যায়, শত শত নারী পুরুষ দাড়িয়ে শীতের কাপড় পছন্দ করছেন। দাম নাগালের ভিতরে থাকায় নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্তরা দেড়শ থেকে ২শ টাকায় জটপট কাপড় কিনে নিচ্ছেন। ওই ব্যবসায়ীর সাথে আলাপচারিতা হলে জানান, রংপুর থেকে ১০ বছর ধরে এই শহরে ব্যবসা করছেন। তিনি ঢাকা, চট্রগ্রাম থেকে এসব শীতের কাপড় এনে এখানে বিক্রি করে থাকেন। সম্প্রতি শীত বৃদ্ধি পাওয়ায় ও দাম নাগালের ভিতরে থাকায় এক সপ্তাহ যাবৎ খুব বেশী ওই কাপড় বিক্রি হচ্ছে। আব্দুল হান্নান নামের পাহাড় বর্ষিজোড়া এলাকার এক গাড়ি চালক আসেন ওই ফুটপাতে সুয়েটার ক্রয় করতে। তিনি বলেন, পছন্দমত কাপড় ও দাম তুলনামুলক কম হওয়াতে ২শ টাকা দিয়ে একটা সুয়েটার কিনেছি।
এদিকে শীত নিবারনের জন্য জেলার গ্রামাঞ্চলে খড়কুটা জ্বালিয়ে সারি সারি হয়ে আগুনের তাপ দিয়ে শরীর উষ্ণ করছেন। এছাড়াও ঠান্ডাজনিত রোগে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ২ ডজনেরও উপর বয়স্ক ও শিশুরা ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতলটির তত্বাবধায়ক ডাঃ পার্থ সারথী কানোনগো বুধবার দুপুরে মুঠোফোনে এ প্রতিবদেককে জানান, ঠান্ডা জনিত রোগে হাসপাতালে বয়স্ক ও শিশুসহ ২৫ জন রোগী ভর্তি আছেন। উপরমহল থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঠান্ডায় যেন কারো ক্ষতি না হয়। আমরা সেবা দিতে প্রস্তুত আছি। তবে, মানুষ সচেতন হওয়াতে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে এসেছে।
এদিকে শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিসের সহকারী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, শ্রীমঙ্গলে বুধবার (১০ জানুয়ারী) তাপমাত্রা ৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। গত সোমবার ছিল ৫.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের প্রকোপ কত দিন থাকতে পারে জানতে চাইলে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ১১ জানুয়ারীর পর থেকে ঠান্ডা কমে আসতে পারে এরকম একটা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদিকে শীতের প্রকোপে পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, দেশের বৃহত্তম হাকালুকি, কাউয়াদিঘি হাওর ও বাইক্কা বিলে পর্যটকদের তেমন কোন আনাগোন দেখা যাচ্ছেনা। এতে ওই এলাকার ব্যবসা-বানিজ্যও স্থবির হয়ে পড়েছে। এদিকে জেলার সদর ও রাজনগর উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদীতে তেমন একটা মাছের দেখা না মিললেও ক্ষুধার তাড়নায় জেলেদের ঠান্ডা উপেক্ষা করে জাল ঠানতে দেখা যায়।