বয়সের কিংবদন্তী
একজন রাম সিং গোড়ের কাহিনী
অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও খুবই আশাজাগানিয়া চিত্তাকর্ষনীয় সত্য কাহিনী। কাহিনীর সূত্রপাত একজন মানুষের বয়স নিয়ে। সে মানুষটি ১১৯ বছর বয়সেও দিব্যি চলাফেরা করছেন। নিজের ছোটখাটো কাজ নিজেই করেন এবং করতে পারেন। পরিচিতজনদের সাথে গাল-গল্প করার নিমিত্তে বিভিন্ন বাড়ীতে যান এবং প্রতিদিন প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ এখনও হাটাহাটি করেন। বলছিলাম হরিণছড়া চা বাগানের মেকনীছড়া গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ রাম সিং গোড়-এর কথা।
রাম সিং গোড়। তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে জানা যায় গোড়ের বয়স এখন ১১৯ বছর। তার জন্মতারিখ ১৯০৫ সালের ৬ আগস্ট। বাবার নাম বুগুরাম গড় ও মায়ের নাম কুন্তী গড়। তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের গ্রাম মেকনীছড়ায় বসবাস করছেন।
সংবাদ ও গণমাধ্যম থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রতিবেশী ও স্থানীয় লোকজনের ধারণায়, রাম সিং পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষ মানুষ। কারণ, এ পর্যন্ত ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ পুরুষের বয়স ১১১ বছর। আরো জানা গেছে যে, প্রায় ২০০ বছর আগে রাম সিং গড়ের দাদা ও বাবা বুগুরাম গড় ভারতের মধ্যপ্রদেশের জবলপুর থেকে চা শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন এবং মেকনীছড়ায় তারা বসবাস শুরু করেন। এখনও তারা সেই গ্রামেই বসবাস করছেন।
তথ্য আরো যাচাই-বাছাই করে স্থানীয় প্রশাসন রাম সিংয়ের নাম গিনেস রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে পারেন এবং পাঠাবেন বলে আমাদের আস্তা আছে।
পত্রিকারান্তরে রাম সিং-এর নিজের ভাষায়, তার পূর্বপুরুষেরা চা চাষের জন্য ইংরেজদের হাত ধরে ভারত থেকে এখানে আসেন। দু’শ বছর আগে তার দাদা শাম্মি গড়, নানা হালকু গড়ের সঙ্গে তাঁর বাবা বুগুরাম গড় ভারতের মধ্যপ্রদেশের জবলপুর থেকে চা শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। এখানে আসার পর তাঁর বাবা বিয়ে করেন। তাঁদের হাত ধরে শুরু হয় এ দেশে চা চাষ। তাঁর দাদা ও বাবার হাতে শ্রীমঙ্গলের পুটিয়াছড়া চা-বাগান জন্ম নেয় এবং তিনি নিজ হাতে জঙ্গল কেটে তৈরী করেন হরিণছড়া চা-বাগান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর বিয়ে করেন তিনি। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক মেয়ে সন্তান ছিল। কয়েক বছর আগে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তিনি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। সেই স্ত্রীর ঘরে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ৮০ বছর বয়সে মারা যান কয়েক বছর আগে।
যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়, তখন তিনি হরিণছড়া চা বাগানের চৌকিদার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও তিনি বাগানেই কাজ করতেন। ইংরেজ সাহেবদের কাছে এই যুদ্ধের কথা শুনেন। আকাশে প্লেনের উড়াউড়ি দেখেন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ সব ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে তাঁর অনেক স্মৃতি রয়েছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্রদের মারা যাওয়ার খবর তখন তিনি শুনেছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় হরিণছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও কর্মীরা পালিয়ে যান। কিন্তু তিনি পালাননি। পুরো ৯ মাস হরিণছড়া চা বাগানেই ছিলেন। তিনি শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তখন তিনি মৌলভীবাজার সড়কের কোনো এক হিন্দু পরিবারে থেকে পড়ালেখা করতেন। এ সময় শ্রীমঙ্গলে কোনো পাকা সড়ক ছিল না। ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের একপাশে পাকা ঘর ছিল, আরেক পাশে ছিল ছনেরঘর। সেখান তিনি ক্লাস করতেন।
সংবাদ প্রতিবেদককে রাম সিং আরো বলেন, তার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর প্রায় ৬৫-৬৬ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই সংসারে পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে জন্ম নেয়। আগের সংসারে শুধু একটি মেয়ে ছিল। আগের সংসারের মেয়ে ও পরের সংসারের বড় ছেলে এরমধ্যেই মারা গেছেন। ছেলে-মেয়ের ঘরের একাধিক নাতি-নাতনী বিয়ে দিয়েছেন। তাদের সন্তানও ১৫-১৬ বছর বয়সী।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান যে, রাম সিং গড়ের তথ্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে রাম সিং গড়ের সব তথ্য পাঠানো হবে।