হারুনূর রশীদ।।
সে ২০১২ কি তেরো সালের কথা। সময় তখন বিকেলও নয় আবার সন্ধ্যাও নেমে আসেনি। গোধূলীও বলা যায়না। মনুসেতুর রেলিং-এ ভর করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজন আলাপ করছিলাম। কতদিন পরে রুনু হালদারের সাথে দেখা। দূরালাপনীতে বহু আলাপ করে তাকে মৌলভীবাজার আসার অনুরোধ করেছিলাম। সে কথা রেখেছিল। মৌলভীবাজার এসেছিল। যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৩এর পর এই প্রথম তার সাথে দেখা। শামসুল হোসেন চৌধুরী শাম্মীর সতীর্থ। দু’জনে খুবই গলা-গলিভাব সে স্বাধীনতার আগ থেকেই দেখে এসেছি।
“হালদার লজ”। লবচান্দ হালদারের ছেলে সুরেশ হালদারের শহরের বাসার নাম। বলতে গেলে হাটি হাটি পা পা করে তখনও মৌলভীবাজার, শহর হিসেবে গড়ে উঠছে। শহরের পশ্চিমাংশে বরহাট গ্রামের পূর্বপ্রান্তে মনু তীর লাগোয়া ছিল শ্মশানঘাট। তার পাশেই ছিল চিড়িয়াখানা। সেখান থেকে নদীর কূল ঘেঁষে একটি ইটবিছানো রাস্তা পূর্বমুখী হয়ে মনুসেতুর নিচদিয়ে লম্বালম্বি “বণবিভাগ”এর বীট অফিস পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে। এর পর বিস্তীর্ণ ক্ষেতের মাঠ। শহরের সীমানা এখানেই শেষ। “ফরেষ্ট অফিস রোড” বলে রাস্তাটি সকলের কাছে সুপরিচিত ছিল। ষড়ঋতুর, মেঘ ঝড় ঝড় বর্ষা ছাড়া, গ্রীষ্ম শরৎ হেমন্ত শীত বসন্তের পরন্ত বিকেলে মানুষের আনাগোনায় এই রাস্তা মুখর হয়ে থাকতো। হাটি হাটি পা পা করে শান্ত ধীরে গড়ে উঠা মলইবাজারের শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত মানুষজনকে এই রাস্তা দিয়ে পায়ে হেটে নদী তীরের নির্মল হাওয়া খেয়ে ঘুরতে দেখেছি। মনুতীরে বসা রসিকজনের অট্টহাসি কত পথিকের পিলে চমকাতো, হাওয়া খেতে তীরে বসা শহরের শ্রেষ্ঠ নাট্যাভিনেতা বীরেন্দ্র দা’দের নাট্য ডায়লগ-“কৈ হায়, শরাবি লে আও” অনেক শহর বধুর মন কাড়তো। এখনও আমার কানে বাজে।
রাস্তাটি এখনও আছে কিন্তু আগের শ্রী হারিয়ে বেশ কয়েকটি স্থানে প্রতিবেশী রাস্তার সাহায্য নিয়ে অনেকটা বিকলাঙ্গের মত এগিয়ে গেছে। জবর দখলের লজ্জায় ম্লান হয়ে সোজামুখি হাটতে পারেনি। কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা হারিয়ে গিয়ে বাড়ীঘর উঠে গেছে। শহরায়নের নব্য নতুন দালান রাস্তা আটকে দিয়ে কর্কশস্বরে জানান দিয়ে বলছে-“আর তোমাকে যেতে দেয়া যায়না বাঁচাধন। এখানে থামো। রাস্তা বেচারা কি আর করে। লজ্জা, রাগ ও অভিমানে মনের দুঃখ ঝাড়তে গিয়ে পাশের রাস্তার সাথে সখ্যতা করে এগিয়ে গেছে গন্তব্যে।
সে রাস্তারই মনুসেতুর কাছাকাছি এক নিরালা নিবির ছায়াঘেরা পুষ্প বৃক্ষ পাশে চৌপথসংযোগস্থলে ছিল “হালদার লজ”। শহরে সে সময়ে হাতে গোনা যে কয়টি ছোট বড় বাসা ছিল “হালদার লজ” তাদের মধ্যে একটি। ছোট্ট বৈঠকখানা, খুবই রুচিসম্মত সাজে সাজানো থাকতো। বাড়ীটির মালিক, সে সময়ের ‘বাসতলার হালদার’ পরিবারের সুসন্তান সুরেশ হালদার। তিনি ছিলেন “লবচান্দ স্টেট” এর জমিদার লবচান্দ হালদারের দ্বিতীয় পুত্র। এক প্রভাবশালী বনেদী পরিবার যাদের হালদার বলে সকলেই চিনতো। প্রয়াত শৈলেন হালদারের কাছ থেকে শুনা, সে ১৯৫২ কি ৫৩সালের কাহিনী। রুনুর বাবা সেই সুরেশ হালদার তার যৌবনে নিজের বন্দুক দিয়ে বাঘ শিকার করেন। যা অত্রাঞ্চলের জন্য সে সময়ে খুবই শৌর্য্যবীর্য ও গৌরব সুনামের বিষয় ছিল। যৌবনে সুরেশ হালদার সবসময় তার সাথে একজন নেপালি ব্যক্তিগত পাহাড়াদার নিয়ে চলাফেরা করতেন। বাঘ শিকার আর পাহাড়াদার রাখার কাহিনী শুনেছিলাম এই রুনু হালদারের কাছ থেকে। আমাদের বাল্যেও রুনুর বাবা সুরেশ হালদার মহাশয়কে দেখেছি খুব আসর জমানো আর সাহসী মানুষ হিসেবে। হালদার মহাশয় মধ্য বয়সে এসে জেদের বশবর্তী হয়ে ওকালতী পাশ করে মৌলভীবাজার উকীল বারে উকালতি করেছেন। ১৯৭৩ কি ৭৪ সালের দিকে তিনি সপরিবারে সিলেট চলে যান। অনেক পরে ক্যানাডায় পাড়ি জমান। শুনা কথা বাসতলার “লবচান্দ স্টেট” থেকে সোঝা উত্তরমুখী হয়ে মনুনদী পাড় হয়ে সে সময়ের রাজনগর যেতে এই হালদারদের কারো জমির উপর দিয়ে যেতে হতো না। এতো বিশাল স্টেটের মালিক ছিলেন লবচান্দ হালদার। জীবনযুদ্ধে হার না মানা হালদার পরিবারের সেই সুরেশ হালদারের দ্বিতীয় সন্তান ছিল এডভোকেট রুনু হালদার। আসল নাম সুব্রত হালদার। পেশায় উকীল, পাহাড়ী সে রাঙ্গামাটী এলাকায়। বাবাও উকীল ছিলেন। কাকা শৈলেশ হালদারও ছিলেন শহরের ডাকসাইটে মোহরার।
স্বাধীনতার পর রুনু হালদার উকালতির সফল এলাকা বিবেচনায় চলে যায় রাঙ্গামাটির সেই পাহাড়ী এলাকায়। এর পর থেকেই আর যোগাযোগ হয়নি আমার সাথে। রুনু বয়সে আমার ছোট আবার লেখা-পড়ায়ও আমার এক কি দু’বছর পরের ছাত্র। কিন্তু এতো প্রাণখোলা আর হাস্যোজ্জ্বল মানুষ আমার অগোছালো জীবনে যে দু’একজনকে পেয়েছিলাম সে তাদেরই একজন।
যতদূর মনে পড়ছে, সে উনিশ’শ বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারী, মার্চ কিংবা এপ্রিল মাসের কথা। যুদ্ধ শেষে একাত্তুরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে পুরো ১৯৭২ সন পর্যন্ত মৌলভীবাজার একটি অস্তির সময় পার করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মহকুমার শান্তি ও আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষায় আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযু্দ্ধের নেতৃত্ব একেবারে নাজেহাল অবস্থায়। শুরু থেকেই এখানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয় দু’টি বলয়ে বিভক্ত থেকে। এমনিতেই সারা দেশব্যাপী তেমন কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিলনা। সোহরাওয়ার্দি উদ্যান বা তৎকালীন সময়ের রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের ভাষণ কে দেবেন এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ছাত্র নেতৃত্বের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। আমরা মফঃস্বলের একটি মহকুমা শহরে থেকে সে খবর পেতাম। আমাদের মাঝেও তখন গুঞ্জন চলছে কে দেবে ৭ই মার্চে ভাষণ? মৌলানা ভাষাণী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ না-কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। না-কি তিনজনই। আমরা কতিপয় মনের দিক থেকে একটু ভেঙ্গে পড়লেও বাহিরের দিকে অন্যদের প্রতি শক্তমনোভাব দেখাতাম। মহকুমা সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক প্রকাশ্য সভা শেষে বাসায় ফিরছিলাম। সভায় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্র থেকে আসা সে সময়ের ছাত্রনেতা জনাব আব্দুর রউফ ও গিয়াস উদ্দীন মনির। খুব সম্ভবতঃ তাদের কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুই রেসকোর্সে ৭ই মার্চে জাতীর পক্ষ থেকে ভাষণ দেবেন। আর কেউ নয়। বিজয়ের আনন্দ যে কত মহান গৌরবের সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।
বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান(সর্বজন প্রিয় আজিজভাই) তখন এমপিএ। গণসংযোগ কমিটির প্রধান তখন মাতার কাপনের বেগের বাড়ীর মীর্জা আজিজ বেগ। আজিজুর রহমান ও মীর্জা আজিজ বেগ দু’জন দু’দিগন্তের মানুষ। নাটকের সেই ‘কোথায়ও কেউ নেই’ এর মত অবস্থা। পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ নেই। অফিস আদালত সর্বত্র কাজের মানুষের সংকট। আইন শৃঙ্ক্ষলা বলতে কিছুই নেই। সারা দেশের মত মৌলভীবাজারেও সে একই অবস্থা। সর্বত্র নাই নাই আর খাই খাই। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুধী শক্তি ঘাপটি মেরে বসে থেকে এ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। অন্যদিকে সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরৎ মুক্তিযোদ্ধাগন তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শক্তি কোন এক অজ্ঞাত কারণে চেতনা বিচ্যুত হয়ে আখের গোছানোর চিন্তায় উদ্ভ্রান্তের মত যত্র তত্র ছুটছে। সুশৃঙ্খলতো নয়ই বরং বহুদা বিভক্ত। কে কাকে থামায়। যার যেমন খুশী চলছে। কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাসহ শহরের ভাল ভাল গণ্যমান্যলোক, সীমান্তের অপারে মালামাল পৌঁছে দেয়ার ঠিকার কাজ করে কিছু আয়-রোজগারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এ সময়ই বহু মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ডাকাতির অভিযোগ উঠে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে চাঁদা আদায়ের জন্য। ব্যবসাই নেই চাঁদা দেবে কোত্থেকে! নব্য ব্যবসায়ীদের দাপটে আসল ব্যবসায়ীগনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়েই আওয়ামীলীগ সেজে যাওয়া লোকজন সব লাইসেন্স-পারমিট বাগিয়ে নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। সাথে কতিপয় ছাত্রলীগের মানুষজনদেরও হাতে রাখার কারণে ব্যবসার লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগের লোকজন সরকারী খাস জমির গাছ অবৈধভাবে কেটে নিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করতে ব্যস্ত বহু সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামীলীগ ও গণসংযোগ কমিটির লোকজন সভায় বসেন সুরাহার জন্য। কিন্তু কি দিয়ে কি হবে। সর্বত্র সঠিক বিশ্বস্ত মানুষের অভাব। তেমনি এক সভায় আমাকে বলা হল শহরে কয়েকদিনের জন্য পাহাড়ার ব্যবস্থা করতে। আমার অপারগতা প্রকাশ করলাম। তবুও অনেকটা জোড়খাটিয়েই মৌখিকভাবে এ কঠিন কঠোর দায়ীত্ব আমাকে দেয়া হলো। বলা হলো মাত্র কয়েকদিন। প্রথম দিন কাটলো জীবনের হুমকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এক নেতার বাসা থেকে চোরাই কাঠ উদ্ধার করতে। সবেমাত্র সকাল ৯টা কি ১০টা হবে। সূর্য্যের আলোয় তখনও তেজ আসেনি। দক্ষিনা হাওয়া বেরীলেইকের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ তুলে উত্তরিমুখে নব্যবোনা ক্ষেতের জমিতে দোলা দিয়ে দিয়ে প্রস্থান করছে। বেরীর অপারে পশ্চিমপ্রান্ত ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলেগেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। সেই সড়কের লাগোয়া পূবে জল থৈথৈ বেরী হ্রদ। প্রকৃতির সে এক অপার লীলা! পাখিডাকা ভোরে এসে এই বেরী হ্রদের পশ্চিম তীরে সড়কে দাঁড়ালে, উঠন্ত সূর্য্যের কোমল লালিমার স্পর্শ যে কোন মানুষের মনকে হারিয়ে নিয়ে যাবে অতীতে, বহুদূর অতীতে; সন-কালহীন এক অদেখা অরণ্য অতীতে!
আমি হাটছি। শহরের পশ্চিম দিকে শাহমোস্তাফার কবরস্থানের কাছে দু’জন আটকালেন। একজন আমার খুবই পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা অন্যজন সুপরিচিত সৈয়দ কুলজাত এক বড়ভাই। অঙ্গুলী নির্দেশে একটি বাড়ী দেখিয়ে আমাকে বললেন- “সকলের চোখের সামনে এতোসব ঘটছে, আপনারা কি করছেন এসব?” অপরজন বললেন, তুমি আমিওতো মুক্তিযোদ্ধা, না-কি? আমরাতো এ সব করছি না। তা’হলে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে অন্যরা করবে কেনো? এসব অপকর্ম শক্তহাতে দমন করতে হবে। অন্যজন আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বললেন। উদ্ধার হলো দুই ট্রাক চোরাই কাঠ। দ্বিতীয় রাত ধরা হলো রেডক্রসের মালামাল নিয়ে ভারত থেকে আসা ট্রাকে করে মৌলভীবাজার থেকে ভারতে পাচারকরা তিন ট্রাক মৎস্য। কারবারী শহরের নামী-দামী মানুষ। দুই দিন-রাতের ঘটনায় আমার সাথে যারা ছিলেন বলতে গেলে অনেকেই বিভিন্ন কারণে সটকে পড়লেন। কেউ ভয়ে, কেউ কোন লাভ নেই দেখে। তৃতীয় রাতে আমি ঠিক সময়েই বের হলাম। কিন্তু আর কাউকে পাওয়া গেল না শুধু রুনু হালদার ছাড়া। আমরা যে কয়েকজন যে ক’দিন রাতে একখানা টয়োটা গাড়ী নিয়ে পাহাড়া দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে রুনু হালদারও একজন ছিল। পাহাড়ার তৃতীয় দিনে ছিলেন নতুন দু’জন ছিলেন কাশীনাথ সড়কের শামসুল হোসেন চৌধুরী(বর্তমানে ঢাকায় থাকেন) ও শান্তিবাগের সৈয়দ আবু বক্কর(বর্তমানে আমেরিকায় আছেন)। এর অনেক অনেক দিন পর রুনুর সাথে দেখা হয়েছিল মনুসেতুর রেলিংএ বসে। আজ খুব মনে পড়ছে রুনুকে। রুনু আমাকে বহুবার বলেছিল ওর ওখানে যেতে। কিন্তু আমি যেতে পারিনি। রুনু কিন্তু এসেছিল, রুনু কথা রেখেছিল।