সেকালে ছাত্রনেতাদের মানুষ সমীহের চোখে দেখতো, ভয়ের চোখে নয়। ছাত্রনেতারা বিবেক ইজারা রেখে রাজনীতি করতেন না তখন। নীতি ও আদর্শে আপসহীন ঐসব ছাত্রনেতারা ছিলেন ভরসার ঠিকানা।ছাত্রনেতা’র সংজ্ঞা পাল্টে গেছে একালে। ছাত্রনেতা শব্দটি কী এতোই ওজনহীন! প্রকৃত ছাত্রনেতা’র কিছু বিশেষ বিশেষণ যেন এখন মূল্যহীন! সময়টাই এখন ট্যাগিংয়ের। যে যেভাবে পারছে যেখানে পারছে নামের আগে এটা-সেটা বিশেষণ ট্যাগ করছে, মূল ঘটনা যা-ই থাকুক! নির্বোধ, বেমানান এক সময়ের সঙ্গী আমরা!ছাত্রনেতা হতে হলে ত্যাগের, সংগ্রামের, অনুরাগের ছাত্র রাজনীতির একটা দীর্ঘ, আদর্শিক, মজবুত ইতিহাস থাকতে হয়। ছাত্রাবস্থায় সাধারণ কর্মী থেকে উঠে এসে পাড়ি দিতে হয় ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বের বিভিন্ন ধাপ। ছাত্রদের নেতা হতে হলে সাধারণ ছাত্র, নিজ সংগঠন ও কর্মীদের প্রতি থাকতে হয় নিখাদ কমিটম্যান্ট ও লয়েলটি।
ছাত্রনেতার জন্ম হয় ছাত্র রাজনীতির একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, ঘটনাক্রমে দুই-চারদিন মিছিলে গিয়ে নয়। আন্দোলন-সংগ্রামের তিক্ত অলিগলিতেই ছাত্রনেতা সৃষ্টি হয়। আদর্শিক লড়াইয়ে, দাবি আদায়ের পিচঢালা রাজপথে, মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত কলেজ ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন হাঁটতে হাঁটতে যাদের স্যান্ডেলের তলা ছিদ্র হয়ে যেতো সেইসব শুষ্ক, রঙ জ্বলা চেহারার তেজস্বী এমন মানুষকেই তখন ছাত্রনেতা হিসেবেই সবাই জানতো। সকল অন্যায় ও অনিয়মকে রুখে দেবার, সমাজের স্তরে স্তরে লুকিয়ে থাকা আবর্জনা মুছে দেবার, পাল্টে দেবার একরোখা প্রতিবাদী স্বপ্ন তাদের চোখে-মুখে ল্যাপ্টে থাকতো অহর্নিশ। শিক্ষিত, সুবক্তা, সুচরিত্র, ইতিহাস জ্ঞান, কর্মীবান্ধব, রাজনৈতিক সচেতন, সাংগঠনিক দক্ষতা, নীতি ও আদর্শে অটল ইত্যাদি গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তখনকার ছাত্রনেতারা। টাকা কামানোর ধান্দায় ছাত্র রাজনীতি সেটা তারা তখন জানতেনই না। নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই তারা ছাত্র রাজনীতি করেছেন। এরাই প্রকৃত ছাত্রনেতা, রাষ্ট্র গড়ার কারিগর। কিংবদন্তি, তুখোড়, রাজপথ কাঁপানো, আদর্শবান ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের নামের আগেই মানায় এবং মানাতো। প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেতা, ছাত্রনেতা সৃষ্টি করে। ষাট, সত্তর, আশির দশক এবং নব্বই দশকের কিছুটা সময় ছিল ছাত্র রাজনীতির সোনালি সময়। বিশেষ করে ষাটের দশকের উত্তাল সময়টা বাঘা বাঘা ছাত্রনেতার জন্ম দিয়েছে এই ভূখন্ডে। গুণগত দিক সহ অন্যান্য দিক বিবেচনা করলে গোটা রাজনীতি এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। স্বাভাবিক ধারার ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ ও কন্সট্রাকটিভ ছাত্র রাজনীতি না থাকলে মানসম্পন্ন ছাত্রনেতার জন্ম হবে না। আর মানসম্পন্ন ছাত্রনেতার জন্ম না হলে জাতীয় রাজনীতি একদিন পুরোটাই অরাজনৈতিক ব্যক্তি এবং তাদের ষন্ডাপান্ডাদের দখলে চলে যাবে। অযোগ্যরা কখনোই দখল করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত যোগ্যরা সেই সুযোগ করে না দেয়। রাজনীতির এমন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব রাষ্ট্রের জন্য চরম ক্ষতিকর। রাজনীতিটা দিনদিন যতোই কঠিন হোক না কেন রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনীতিবিদদের উপস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে স্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক চর্চা আবশ্যক। ডাক্তার যতোই কসাই হোক না কেন ডাক্তারের কাজ মোক্তার দিয়ে হবে না। রাজনীতিবিদরা পচে গেলেও রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকতে হবে, থাকাটা জরুরি; নতুবা রাষ্ট্র ও রাজনীতি পথ হারাবে। |