হারুনূর রশীদ।। ১৮ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে মারাকাশ বিমানবন্দরে গিয়ে নামলাম। জীবনে কখনও ভাবিনি মারাকাশ দেখবো। মারাকাশ শব্দটির সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে বলতে গেলে খুব অল্পদিন হলো। আমার ভ্রমণপাগল মেয়ে খুবই ধর্মপ্রান। সবসময় খুঁজে খুঁজে বের করবে কোথায় কোথায় মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্যের চমক আছে। ছেলেটাও অনেকটা একই স্বভাবের। ছেলে অবশ্য ধর্ম বিষয়ে মেয়ের মত ওতো গোলমেলে নয়। আমার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে সাংবাদিকতা পড়াবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সাংবাদিকতাকেই বিষয় হিসেবে বেচে নিয়েছিল। সাংবাদিকতা বিষয় নিয়ে বিএ পাশ করার পর এমএ পড়তে গিয়ে কি কারণে জানিনা বিষয় বদলে নিয়ে আরবিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতি গ্রহন করে।
![]() |
![]() |
মেয়েটি আমার খুবই মায়াবতী আর সদা হাসিখুশী মনের মানুষ। আমার চেয়েও বেশী কষ্ট সহ্য করতে পারে। সারাদিন কাজের মাঝে ডুবে থাকতে ভালবাসে। সেই আমার প্রানপ্রিয় কন্যার সাথে এক বিকেলে ঘরে বসে আমরা সকলে গল্পকরে সময় কাটাচ্ছিলাম। সেই গল্পের এক ফাঁকে আমার ছেলে জিজ্ঞেস করলো স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য তার মা’কে নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাওয়া সবদিক থেকে ভাল হবে। তখনই আমার মেয়ে বললো, মারাকাশ খুব ভাল হবে। এই প্রথম আমি মারাকাশ শব্দটি শুনতে পাই। আমি জানতে চাইলাম মারাকাশ আবার কোথায়। ছেলে-মেয়ে দু’জনই অবাক হয়ে বললো আব্বু তুমি একজন সাংবাদিক। আর মারাকাশ কোথায় জানো না?
![]() |
![]() |
মনে মনে একটু লজ্জিত হলাম। যৌবনে নিজের গ্রামীন শহরে বহু নাটকে অংশ নিয়েছি, অভিনয় করেছি। খুব যে উন্নতমানের বিখ্যাত কিছু ছিলাম বা হয়েছিলাম তেমন কিছু নয়। তবে অভিনয়ে মুন্সিয়ানা আনার কলা-কৌশল বেশ শিখেছিলাম। সে কৌশলেই নিজের লজ্জাভাবকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম। কথায় আটকে গেছি দেখে ছেলে-মেয়ে দু’জনও বুঝে নিয়েছে ভূগোল সম্বন্ধে আমার দৌড় যে খুব বেশী নেই। তাদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম মারাকাশ প্রাচীন মরোক্ক দেশের প্রাচীনতম রাজধানীর নাম। স্বভাব বশতঃ অনেক কিছু ঘাটাঘাটি করে মারাকাশ সম্বন্ধে জেনে নিতে ভুল করলাম না। বহু প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী সেই মাররাকাশ ঘুরে এলাম।
![]() |
![]() |
১৮ ডিসেম্বর দুপুর প্রায় দু’টোর দিকে মারাকাশ বিমানবন্দরে গিয়ে নামলাম। খুবই পরিপাটি ছিমছাম বিমানবন্দর। বন্দরের অভিবাসন কাজ শেষ করে অনুমানিক স্বাভাবিক সময়ের মধ্যেই বের হয়ে আসলাম। সময় লাগলো তবে স্বাভাবিক। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় কোনই সমস্যা হয়নি। একটি বিষয় এখানে বলার আগ্রহ দমন করতে পারছিনা। গোটা চার-পাঁচ ইউরোপের দেশসহ এ পর্যন্ত বেশ আট-দশটি দেশ খুব ভাল রূপেই ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বিভিন্ন এ সবদেশ ঘুরতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বৃটিশ পাসপোর্টের একটি ভিন্ন মর্যাদা রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলি এমনিতেই তাদের সকল দেশকেই মর্যাদার চোখে দেখে। ইউরোপের বাইরের অন্যান্য দেশেও বৃটিশ পাসপোর্টের বিষয়ে অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে খুবই নমনীয় অনুভুত হয়েছে আমার কাছে। সে নমনীয়তা অবশ্য ধনী দেশ বা শক্তিশালী দেশ এজন্য নয়, তাদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষনের স্বচ্চ মজবুত পদ্বতিই সম্ভবতঃ এমন মর্যাদার কারণ। অবশেষে অভিবাসনের দাপ্তরিক কাজ শেষ করে মাররাকাশের সূর্যোজ্জ্বল আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালাম। বাহিরে অসংখ্য ব্যবসায়িক গাড়ী গাড়ী রাখার জায়গায় সুশৃঙ্ক্ষলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ীর চালক একটি কার্ডের মত কাগজে তাদের নির্দিষ্ট যাত্রীর নাম লিখে বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। আমাদের যিনি নিতে এসেছেন তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা। বেশ মিনিট কয়েক পরে একজন হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ এসে আমার ছেলেকে সুধালেন, আপনার নাম কি মাহমুদ? ছেলে জবাবে হ্যাঁ বলতেই তিনি বেশ কাচু-মাচু করে বললেন, দেখুন আমিতো ভেতরে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার যাত্রী পাচ্ছি না দেখে সন্দহবশতঃ বাইরে এসেছি। আমার ধারনা হলো হয়তো আপনারা বেখেয়ালে গাড়ী পার্কের পথে না গিয়ে সোঝাসুজি বের হয়ে আসতে পারেন। এসে পেয়েও গেলাম। আমার কোন দোষ নেবেন না। ছেলে আমার ঘরে একমাত্র ছোট বোনের সাথে প্রায় সময়ই ব্যাঘ্র মেজাজ নিয়ে কথা বলে কিন্তু বাইরে সে খুবই কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক। ছেলে বললো না না এতে দোষের কি আছে। এইতো মাত্র কয়েক মিনিট আমরা বেরিয়ে এসেছি। ঠিক আছে চলেন। বলুন কোন দিকে যেতে হবে। ড্রাইভার পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। আমরাও গিয়ে গাড়ীতে উঠলাম।
![]() |
![]() |
মাররাকাশ শহরের পথে গাড়ী চলতে লাগলো। ড্রাইভার আব্দাল মালিক। মাররাকাশের মানুষ। হেংলা ছিপছিপে গড়নের মানুষ। খুব আলাপি। তার আলাপের সূত্রে জানতে পারলাম মাররাকাশের গাড়ীর ড্রাইভার বেশীর ভাগ মাররাকাশেরই মানুষ। এদের মাঝে বেশ বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী ও মালয়েশিয়ান আছেন। প্রায় পাঁচচল্লিশ মিনিট গাড়ীতে বসে আমরা গল্প গল্প করতে করতেই একসময় শহরে প্রবেশ করলাম। রাস্তায় আসার পথে একটিও উচ্চতল ভবন চোখে পড়লোনা। দোতলা-তিনতলা আর পাঁচতলাই সবক’টি। বহুতল ভবন একেবারেই চোখে পড়লো না। আলাপের ফাঁকে ফাঁকেই আমি এসব দেখছিলাম। আলাপ করতে করতেই একসময় হোটেলের সামনে এসে গাড়ী পৌঁছালো। গাড়ী থেকে নেমেই বুঝতে পারলাম এলাকাটি ভদ্র ধনিমানুষ আর পর্যটকদের এলাকা। একটি বড় দ্বিমুখী রাস্তা থেকে ছোট অপর একটি রাস্তা ভেতরের দিকে গেছে। ওই তেমুড়ায় লাইন ধরে দাঁড়ানো সুন্দর সুন্দর সাঁজের ঘোড়ার গাড়ী। দেখেই বুঝা যায় এ গাড়ীগুলো পর্যটকদের নিয়েই শহর ভ্রমনে ভাড়া যায়। ভেতরের রাস্তার উভয় পাশে ত্রিতল বাড়ীঘর। প্রতিটি ঘরের নিচের তলায় সুন্দর করে সাজানো দামী দামী জিনিষের দোকানপাট ও ভেতরের একটি কোনায় খুব সুন্দরকরে সাজানো একটি রেঁস্তোরা খদ্দেরে গিজ গিজ করছে। ড্রাইভার দেখালেন ওই রেঁস্তোরারই বিপরীত দিকে বিশাল এলাকানিয়ে তৈরীকরা হয়েছে বৃক্ষলতার বাগান। ফুলের চেয়ে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির ছোটবড় গাছপালাই বেশী। ড্রাইভার আমাদের হোটেল দেখিয়ে দিয়ে বললেন তিনি তার গাড়ী নিয়ে সবসময়ই এই তেমুড়ায় থাকেন। এ এলাকাটি পর্যটকদের এলাকা। এই বাগানটি দেখতেই ভ্রমণকারী পর্যটকেরা এখানে আসেন। তোমাদের ইচ্ছে হলে দেখতে পারো। এই বলে তিনি তার কার্ড আমার ছেলের হাতে দিয়ে বললেন, কোন কাজে প্রয়োজন হলে এই আমার ফোন নাম্বার। ডাক দিলেই আমাকে পাবে। আমরা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। (আগামীকাল দেখুন)