এহেন পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন বিকেলে ঢাকার টিকাটুলির রোজগার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মীদের বিদ্রোহী গ্রুপের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত প্রায় শ’তিনেক প্রতিনিধির সম্মতিতে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান প্রমূখ। ২৪ জুন সদ্যগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় আরমানিটোলা মাঠে। সভায় সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী সরকারের বাইশ মাসের অপকীর্তির খতিয়ান তুলে ধরে সবাইকে আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহবান জানান। একই বছর ১১ অক্টোবর আরমানিটোলা মাঠের আরেক জনসভায় তিনি খাদ্যসমস্যা সমাধানে মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের ব্যর্থতার জন্য তাঁর পদত্যাগ দাবী করে বক্তব্য রাখেন এবং সভাশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবীতে ভূখামিছিল বের করেন। ১৩ অক্টোবর বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরী মিলনায়তনে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ গঠিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কর্মপরিষদের সভায় চিরবিদ্রোহী ভাসানী ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হলে তা ভঙ্গের পক্ষে মত দান করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শহীদানের ঘটনায় তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে নিহতদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাযায় ইমামতি করেন। জানাযা শেষে মোনাজাতের মধ্যে তিনি ক্রোধে ফেটে পরে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির উদ্দেশ্যে কঠোর হুশিয়ারী ও হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবী করেন। ১০ এপ্রিল তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য কারারুদ্ধ হন।
জেল থেকে বেরিয়ে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘মুলনীতি প্রতিরোধ দিবস’ পালনকালে সভাপতির ভাষণে তিনি আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন, রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলার স্বীকৃতি, কেন্দ্রে এককক্ষ বিশিষ্ট পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধুমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ন্যাস্ত করার দাবী জানান। একই বছর ১৪-১৫ নভেম্বর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবকে দলের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন।
৫৮’র ৭ অক্টোবর আইয়্যুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করলে ১২ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে মির্জাপুর হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও মওলানা ভাসানীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির জন্য প্রদেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে জনগণের চাপের মুখে ৪ বছর কারাবরণের পর ৬২’র ৩ নভেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে আইয়্যুবের স্বৈরশাসনের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঘটা করে ‘উন্নয়ন দশক’ উদযাপনের এক পর্যায়ে ৫ ডিসেম্বর আইয়্যুব খান ঢাকায় এলে ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীর আহবানে দেশব্যাপী পূর্বঘোষিত ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ঐ দিনের জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এ দাবি মানা না হলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েম করা হবে। সভা শেষে তাঁর নেতৃত্বে একটি মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুন এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী বলেন, “জীবনের সব সম্পদ হারিয়ে, নারীর ইজ্জত বিকিয়ে, ঘরবাড়ি হারিয়ে, দেশ থেকে বিতারিত হয়ে এবং দশ লক্ষ অমূল্য প্রাণ দান করে স্বাধীন দেশের জনগণ রাজনৈতিক মীমাংসার নামে ধোঁকাবাজি কিছুতেই গ্রহণ করবে না। তাদের একমাত্র পণ- হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু। এর মধ্যে গোজামিলের কোন স্থান নাই।”
পাকিস্তানও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেবল একদলীয় যুদ্ধ বলে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারণাকালে মুক্তিযুদ্ধকে একটি সর্বদলীয় রূপ দিতে ভাসানী-তাজউদ্দিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৭১’র ৯ সেপ্টেম্বর পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে প্রবাসী সরকারের ‘উপদেষ্টা পরিষদ’গঠিত হয়।
৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী। কলকাতার হাজরা স্ট্রীটে অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকে মওলানা ভাসানী কোন রকম আপোষ চক্রান্তের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে ‘সাত দফা’ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এর আগে ৩০-৩১ মে কলকাতার বেলাঘাটায় প্রবাসী বামপন্থী রাজনীতিবিদদের দু’দিনব্যপী এক সম্মেলন শেষে ১ জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নভেম্বর মাসে দেরাদুনে অবস্থানকালে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে ভারত সরকার তাঁকে ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে হাসপাতাল থেকে তাকে দিল্লীর উপকন্ঠে একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশে ফেরার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ২১ জানুয়ারি তিনি আসামের ফরিদগঞ্জে এক জনসভায় ভাষণ দান শেষে ২২ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
সাংবাদিক ছমির উদ্দীনের ফেইচবুক থেকে সংকলিত ও সম্পাদিত
|