সুরঞ্জিত দাসকথা গুলো আজ খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে, ঠিক সাড়ে ছয় বছর আগে, প্রেমের বয়স তখন মাত্র বছর খানেক, ইউনিভার্সিটির শহিদ মিনারের পিছনের দেয়ালে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে মোনা কথাগুলি বলছিল, “বড় পরিবার আমার একদম পছন্দ নয়, দুই রুমের একেবারে ছিমছাম একটা সংসার হবে আমার।” মেয়েরা বোধহয় এরকমই হয়, যা চায় একেবারে নিজের করে চায়, কোন ভাগাভাগি চলবে না। – উঁফফ, লাগছে তো। ঠিক আছে, একটা মাত্র বাবু নিব। কিন্তু আমার বাবুর দৌড়াদৌড়ির জন্য পর্যাপ্ত জায়গায় থাকতে হবে তো, তাই বড় বাসা নিবো। তর্কে আমি সবসময়ই হেরে যাই, হেরে যাওয়াতেই আমার আনন্দ। মাঝেমধ্যে তার কথা শোনে অবাক হতাম, আর বলতাম , এতো বেশি সংসারী হইও না, তোমার পড়াশোনায় মনোযোগী হও। না, তার পড়াশোনায় কখনোই ব্যাঘাত ঘটে নি, অন্তত তার একাডেমিক রেজাল্ট তাই বলে, অনার্সে সে তার ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড হয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমার জীবনে কোন গান এতো ভাল লাগেনি। মোনার কথায় আমার ঘোর কাটলো। সে বলল, জানো, আমি কখনোই তোমার সামনে গান করিনি। তুমিও কোনদিন আমার কাছে গান শুনতে চাও নি। কনসিভ করার পর থেকেই মোনার মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। সফল মা হওয়ার সকল প্রস্তুতি; ইউটিউব, ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি চলছিল সমানতালে। এইসময় প্রতিটি দিন তার কাছে বিশেষ এবং প্রতিটি দিন নিয়ে তার আলাদা পরিকল্পনা। আমি যথাসাধ্য সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এইতো সেইদিন, আমার বুকে তার মাথাটা রেখে তাকে শক্ত করে ধরলাম, আর বললাম, কিচ্ছু হবে না, মোনা। মৃত্যুও আমাদের ভালবাসাকে ভয় পায়। তার ঘন চুলে বিলি দিয়ে দিচ্ছিলাম, কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছে টের পাইনি। মোনার নিস্পাপ মুখটি দেখে খুব মায়া লাগছিল। চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল মোনা আইসিইউতে। চব্বিশটি ঘন্টা ধরে একটি কাঁচের দেয়াল আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। কখন আসবে সে মাহেন্দ্রক্ষণ? আমার মোনা চোখ তুলে তাকাবে, আমাকে ইশারায় ডাকবে, আমি দৌড়ে যাবো, তার কপালে দীর্ঘ চুমু খাবো। এ এক অনন্ত অপেক্ষা, অকর্মণ্য অপেক্ষা, এক অভিসপ্ত অপেক্ষা। মোনার জীবন-মৃত্যুর লড়াই এখন সুতার মতো এক বক্র রেখায় আটকে আছে, কাঁচের দেয়ালের ওপাশে অভিসপ্ত এক মনিটর তাই নির্দেশ করছে। ৮৬,৪০০ সেকেন্ড ধরে আমি ওই রেখার দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। ডাক্তার নামক দেবদূত শুধু বলছেন “আমরা চেস্টা করছি”। আচ্ছা, মোনা এইবার সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরলে একটা বড় সারপ্রাইজ দিতে হবে। পাগলামি সারপ্রাইজ, হুমায়ূন আহমেদ টাইপ। ব্যান্ড পার্টি বাদ্য বাজিয়ে স্বাগত জানাবে, সেই সাথে বাসার সামনে ব্যানার-সমবেত একটি বিশাল গেইট করা যেতে পারে। আমি সাধারণত মোনাকে সারপ্রাইজ দিতে পারিনা, সে আগেই টের পেয়ে যায়। তাছাড়া আমার সারপ্রাইজ গুলো মাথা মোটা টাইপের হয়ে থাকে, যা মোনার পছন্দ নয়। কিন্তু এইবার সত্যি সত্যি ভালো একটা কিছু করতেই হবে। হঠাৎ বিপ বিপ দুটি শব্দ কানে এলো, সাথে সাথে ডাক্তার – নার্সদের ছুটাছুটি। তৎক্ষনাৎ আমার চোখ পড়ল সেই অভিসপ্ত মনিটরে- নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা! ঝাপসা চোখের সামনে দুই তিনটি সরল রেখা ভেসে উঠল। আজন্ম যুক্তিবাদী আর অবিশ্বাসী আমার মন, আজ কোন যুক্তির ধার ধারছে না। শুধু অন্তর আত্মার সবটুকু সমর্পণ করে, করজোড়ে মিনতি করছে, ফিরিয়ে দাও….. প্রভু। ০১.০৮.২০২১ উৎসর্গঃ মৌসুমী নাগ মৌ, সংস্কৃতি কর্মী, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। (২০.০৭.২০২১ খ্রিঃ করোনা আক্রান্ত হয়ে আট মাসের গর্ভবতী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন।) |