1. muktokotha@gmail.com : Harunur Rashid : Harunur Rashid
  2. isaque@hotmail.co.uk : Harun :
  3. harunurrashid@hotmail.com : Muktokotha :
আফ্রোদিতির অপমৃত্যু - মুক্তকথা
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৩:২৯ পূর্বাহ্ন

আফ্রোদিতির অপমৃত্যু

সুরঞ্জিত দাস
  • প্রকাশকাল : বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১
  • ৫১৬ পড়া হয়েছে

সুরঞ্জিত দাস

কথা গুলো আজ খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে, ঠিক সাড়ে ছয় বছর আগে, প্রেমের বয়স তখন মাত্র বছর খানেক, ইউনিভার্সিটির শহিদ মিনারের পিছনের দেয়ালে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে মোনা কথাগুলি বলছিল, “বড় পরিবার আমার একদম পছন্দ নয়, দুই রুমের একেবারে ছিমছাম একটা সংসার হবে আমার।” মেয়েরা বোধহয় এরকমই হয়, যা চায় একেবারে নিজের করে চায়, কোন ভাগাভাগি চলবে না।
– আমি হেসে উত্তর দিলাম, আমার তো ছোট বাসায় হবে না।
– কেন? ভ্রু কুচকে মোনা আমার দিকে তাকালো।
অনেক গুলো বাবু নিবো তো তাই।
মোনা আমার মাথার চুল ধরে জোরে টান দিল।

– উঁফফ, লাগছে তো। ঠিক আছে, একটা মাত্র বাবু নিব। কিন্তু আমার বাবুর দৌড়াদৌড়ির জন্য পর্যাপ্ত জায়গায় থাকতে হবে তো, তাই বড় বাসা নিবো।
মোনা ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড আবেগী একটি মেয়ে, কিন্তু তার বাহ্যিক আচরণ সবসময়ই অসম্ভব প্রেক্টিক্যাল। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত স্পষ্ট। তখন সে মাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী কিন্তু আমাকে নিয়ে সে কোথায় যেতে চায়, কিভাবে যেতে চায় সবই যেন তার পূর্ব নির্ধারিত।
– তোমাকে অবশ্যই বিসিএস ক্যাডার হতে হবে, শিক্ষা ক্যাডার বাদে যেকোনো ক্যাডার হলে চলবে(মহিলা কলেজে পোস্টং হতে পারে, তাই শিক্ষা ক্যাডারে নিষেধাজ্ঞা)। – মোনার কঠিন নির্দেশ।
আমি বললাম, তুমি ক্যাডার হবে না?
– মই কখনো গাছে উঠে না, আমি ক্যাডার নয় সুখী হতে চাই, সুকঠিন কন্ঠে মোনার উত্তর।
– চাকরি করবে না?
– না।
– কিন্তু সুখী হতে হলে তো টাকা প্রয়োজন।
– না জনাব, সুখী হতে হলে ভালবাসা প্রয়োজন।
– জো হুকুম মহারানী, আপনি যা বলবেন তাই হবে।

তর্কে আমি সবসময়ই হেরে যাই, হেরে যাওয়াতেই আমার আনন্দ। মাঝেমধ্যে তার কথা শোনে অবাক হতাম, আর বলতাম , এতো বেশি সংসারী হইও না, তোমার পড়াশোনায় মনোযোগী হও। না, তার পড়াশোনায় কখনোই ব্যাঘাত ঘটে নি, অন্তত তার একাডেমিক রেজাল্ট তাই বলে, অনার্সে সে তার ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড হয়েছিল।
রবার্ট ব্রাউনিং এর কবিতায় পড়েছিলাম, স্ত্রী লুক্রেজিয়ার অনুপ্রেরণার অভাবে এন্ড্রিয়া পারফেক্ট আর্টিস্ট হতে পারেনি। আমার ক্ষেত্রে তার উল্টো হয়েছিল, আমার মতো একজন এলোমেলো মানুষও পথ খোঁজে পেয়েছিল, একজোড়া বিশ্বাসী হাত সাথে ছিল বলে। একটি সত্যিকার ভালবাসা অফুরন্ত সাহস আর শক্তি যোগায়, যা একজন মানুষের পৃথিবী বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
বিয়ের রাতে মোনা বলল, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। মোনার সারপ্রাইজ গুলো অন্যরকম হয়ে থাকে, তাই আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম, কি..?
সে গান ধরল,
শত জন্মের স্বপ্ন তুমি..
আমার জীবনে এলে,
কত সাধনায়, এমন ভাগ্য মেলে….।

আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমার জীবনে কোন গান এতো ভাল লাগেনি। মোনার কথায় আমার ঘোর কাটলো। সে বলল, জানো, আমি কখনোই তোমার সামনে গান করিনি। তুমিও কোনদিন আমার কাছে গান শুনতে চাও নি।
সত্যিই তো! মোনাকে কোনদিন আমি গান করতে শুনিনি। আমার কাছে সবসময়ই সে এমন এক পরিপূর্নতা যে, অন্য কোন কিছু তার মধ্যে আর খোঁজার প্রয়োজন বোধ করিনি। আমি কখনো চাইনি মোনা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু করুক। বিয়ের পরও সে তার সিদ্ধান্তে অটল, সে চাকরি করবে না। মোনার ভাষ্য-
আমি কখনো ব্যর্থ হবো না। আমি একজন সফল নারী হতে চাই, একজন সফল প্রেমিকা, সফল স্ত্রী এবং সফল মা হবো।

কনসিভ করার পর থেকেই মোনার মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। সফল মা হওয়ার সকল প্রস্তুতি; ইউটিউব, ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি চলছিল সমানতালে। এইসময় প্রতিটি দিন তার কাছে বিশেষ এবং প্রতিটি দিন নিয়ে তার আলাদা পরিকল্পনা। আমি যথাসাধ্য সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
মোনা কনসিভ করার সাত মাস পূর্ণ হওয়ার পর থেকেই আমি তার মধ্যে এক ধরনের মানসিক পরিবর্তন খেয়াল করছিলাম। তার মধ্যে আগের মতো প্রাণোচ্ছ্বলতা নেই, মনের মধ্যে কিছুটা ভীতি কাজ করছে। যদি বাবুর কিছু হয়ে যায়, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, এই ধরনের কথাবার্তা বলা শুরু করেছে।

এইতো সেইদিন, আমার বুকে তার মাথাটা রেখে তাকে শক্ত করে ধরলাম, আর বললাম, কিচ্ছু হবে না, মোনা। মৃত্যুও আমাদের ভালবাসাকে ভয় পায়। তার ঘন চুলে বিলি দিয়ে দিচ্ছিলাম, কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছে টের পাইনি। মোনার নিস্পাপ মুখটি দেখে খুব মায়া লাগছিল।

চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল মোনা আইসিইউতে।
সে কোভিড-১৯ পজিটিভ। গতকাল ঠিক এইসময় জ্বর আর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে মোনা এম্বুলেন্সের সিটে ছটপট করছিল। এম্বুলেন্স গগণ বিদারী শব্দ করে রাতের বুক চিরে দ্রুত এগিয়ে চলছে, এমন সময় মোনা আমার হাত শক্ত করে ধরে আকুতি জানায় “সোনা, আমার বাবুকে রক্ষা কর প্লিজ”। তার সাথে সম্পর্কের সাড়ে সাতটি বছর কিভাবে কাটিয়ে দিলাম টের পাইনি। কিন্তু এই চব্বিশটি ঘন্টা আমার জীবনে অনন্তকাল মনে হচ্ছে। আমার মাথা কোন কাজ করছে না, শুধু মনে হচ্ছে, এ হবার নয়, এটা হতে পারে না, এটা নিশ্চয়ই বাস্তব নয়, নিশ্চয়ই কোন দুঃস্বপ্ন। এখনই ঘুম ভেঙ্গে যাবে, দেখবো সবকিছু স্বাভাবিক।

চব্বিশটি ঘন্টা ধরে একটি কাঁচের দেয়াল আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। কখন আসবে সে মাহেন্দ্রক্ষণ? আমার মোনা চোখ তুলে তাকাবে, আমাকে ইশারায় ডাকবে, আমি দৌড়ে যাবো, তার কপালে দীর্ঘ চুমু খাবো। এ এক অনন্ত অপেক্ষা, অকর্মণ্য অপেক্ষা, এক অভিসপ্ত অপেক্ষা। মোনার জীবন-মৃত্যুর লড়াই এখন সুতার মতো এক বক্র রেখায় আটকে আছে, কাঁচের দেয়ালের ওপাশে অভিসপ্ত এক মনিটর তাই নির্দেশ করছে। ৮৬,৪০০ সেকেন্ড ধরে আমি ওই রেখার দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। ডাক্তার নামক দেবদূত শুধু বলছেন “আমরা চেস্টা করছি”।

আচ্ছা, মোনা এইবার সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরলে একটা বড় সারপ্রাইজ দিতে হবে। পাগলামি সারপ্রাইজ, হুমায়ূন আহমেদ টাইপ। ব্যান্ড পার্টি বাদ্য বাজিয়ে স্বাগত জানাবে, সেই সাথে বাসার সামনে ব্যানার-সমবেত একটি বিশাল গেইট করা যেতে পারে। আমি সাধারণত মোনাকে সারপ্রাইজ দিতে পারিনা, সে আগেই টের পেয়ে যায়। তাছাড়া আমার সারপ্রাইজ গুলো মাথা মোটা টাইপের হয়ে থাকে, যা মোনার পছন্দ নয়। কিন্তু এইবার সত্যি সত্যি ভালো একটা কিছু করতেই হবে।

হঠাৎ বিপ বিপ দুটি শব্দ কানে এলো, সাথে সাথে ডাক্তার – নার্সদের ছুটাছুটি। তৎক্ষনাৎ আমার চোখ পড়ল সেই অভিসপ্ত মনিটরে- নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা! ঝাপসা চোখের সামনে দুই তিনটি সরল রেখা ভেসে উঠল।

আজন্ম যুক্তিবাদী আর অবিশ্বাসী আমার মন, আজ কোন যুক্তির ধার ধারছে না। শুধু অন্তর আত্মার সবটুকু সমর্পণ করে, করজোড়ে মিনতি করছে, ফিরিয়ে দাও….. প্রভু।

০১.০৮.২০২১

উৎসর্গঃ মৌসুমী নাগ মৌ, সংস্কৃতি কর্মী, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। (২০.০৭.২০২১ খ্রিঃ করোনা আক্রান্ত হয়ে আট মাসের গর্ভবতী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন।)

এ জাতীয় সংবাদ

তারকা বিনোদন ২ গীতাঞ্জলী মিশ্র

বাংলা দেশের পাখী

বাংগালী জীবন ও মূল ধারার সংস্কৃতি

আসছে কিছু দেখতে থাকুন

© All rights reserved © 2021 muktokotha
Customized BY KINE IT