1. muktokotha@gmail.com : Harunur Rashid : Harunur Rashid
  2. isaque@hotmail.co.uk : Harun :
  3. harunurrashid@hotmail.com : Muktokotha :
আমাদের আলো - মুক্তকথা
বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০১:০০ অপরাহ্ন

আমাদের আলো

সংবাদদাতা
  • প্রকাশকাল : শনিবার, ২৩ জুন, ২০১৮
  • ২৭৮ পড়া হয়েছে
সাংবাদিক রাজনীতিক সৈয়দ মতিউর রহমান

সৈয়দ মতিউর রহমান

হারুনূর রশীদ

ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মত পৌরসভার পাশ দিয়ে বড় সড়কে উঠে কলেজের দিকে রওয়ানা হয়েছি। কাশীনাথ আলাউদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের দালান পাড় হয়ে হাতের ডানে ‘পাবলিক লাইব্রেরী’র দিকে চোখ পড়তেই দেখি পুরনো প্রেসক্লাবের বারান্দায় (যা ষাটের দশকে কিন্ডার গার্টেন স্কুল ছিল। এখন সে ঘরটি নেই। এখন সেখানে স্থানীয় সরকারের দপ্তর গড়ে উঠেছে।) একটি টেবিল নিয়ে বসে আছেন মতিউর ভাই। মাঝে-মধ্যে মতিউরভাইকে এভাবে দেখতাম। তিনি মূলতঃ শহরে তার বোনের বাসায় থাকতেন। খুব জরুরী কোন কাজের তাগিদ থাকলে প্রেসক্লাবের স্মরণাপন্ন হতেন।
শিমূলের বাসন্তিক ছটায় প্রেসক্লাবের বারান্দায় সৈয়দ মতিউরকে দূরের রাস্তা থেকে দেখতে আমার কাছে মনে হতো সত্যিকারের একজন মানবপ্রেমী কলমসাধক তার কলমীহাত থুথুনীতে ঠেকিয়ে দূরের পানে দিগন্তবিস্তৃত আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছেন, কি লিখবেন? সদাহাসিমাখা তার সেই সুন্দর সৌম্যকান্তি মুখমণ্ডল আজও আমায় স্মৃতিকাতর করে তুলে। আমার কাছে এ দৃশ্যের বিশালতা অব্যক্ত অনন্য।
রাজনীতিক সাংবাদিক সৈয়দ মতিউর রহমান। মৌলভীবাজারে বাম ঘরানার সাধারণ মানুষের রাজনীতি আর সাংবাদিকতার পতিকৃতদের তিনি একজন ছিলেন বললে উত্তোক্তি হবেনা। তার আগেও মৌলভীবাজারের মানুষ রাজনীতিতে ছিলেন, সাংবাদিকতায়ও ছিলেন এবং তারা কালোজয়ী মানুষ হয়ে আছেন ও থাকবেন চিরকাল। এখানে তাদের ইতিহাস বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সৈয়দ মতিউর রহমান তাদেরই উত্তরসূরী একজন হয়েও তাদের থেকে একটু ভিন্ন এক মানুষ ছিলেন। অন্যরা বৈষয়িক আয়-উন্নতির দূর্নিবার বাসনায় জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে স্ব-স্ব অঙ্গনে নিজ মেধা ও সাধনাবলে স্থান করেছেন। আর এখানেই সৈয়দ মতিউর স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ও ভিন্ন।
প্রয়াত শফকতুল ওয়াহেদের কাছ থেকে জেনেছিলাম বলে স্মৃতি থেকে যতটুকু মনে পড়ছে, সৈয়দ মতিউর রহমান, পাকিস্তান আমলে সুনামগঞ্জের প্রয়াত মাহমুদ আলী সাহেবের ‘নও বেলাল’ পত্রিকায় কাজ করেছেন বহুদিন। ওখান থেকেই তার রাজনীতি ও সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। আসাম সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদ আলী। পরে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন ‘গণতন্ত্রী দল’র সাধারণ সম্পাদকের দায়ীত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহন করেন। তিনি একজন প্রগতিশীল বাম ঘরানার রাজনীতিক ছিলেন। অনুমান সৈয়দ মতিউরের বাম ঘেষা সাধারণ মানুষের রাজনীতির উন্মেষও সেখান থেকে। প্রয়াত মাহমুদ আলী পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে ‘বাংলা’কে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবী উত্তাপন করেছিলেন এবং এর পক্ষে তার ‘নও বেলাল’ পত্রিকার মাধ্যমে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। পরে অবশ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানীদের সমর্থন দিয়েছিলেন।
ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি ও শ্রুতি থেকে জানা তথ্যের আলোকে যা নির্দ্বিধায় বলা যায় তা’হলো- শহর মৌলভীবাজার ও এর আশ-পাশ অঞ্চলে রাজনীতি ছিল সরাসরি ভূ-স্বামীদের বিচারিক বৈঠকখানায় সীমাবদ্ধ। সামন্তবাদী সংস্কৃতির বিলাসী-বৈঠকী এই রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের মাঠ-ময়দানের রাজনীতি হিসেবে গন্যকরে বস্তুনিষ্ঠভাবে এতদাঞ্চলে যারা প্রকাশ্য বা গোপনে কাজ করেছেন তাদের মধ্যেকার একজন ছিলেন প্রয়াত সৈয়দ মতিউর রহমান। মতিউর রহমান ভেঙ্গেপড়া আমাদের সমাজকে বুঝতে পেরেছিলেন ভেতর থেকে। অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই সে সময়ের সাংবাদিকতাও সেই রাজনীতির পরিপূরক হিসেবেই কাজ করেছে দীর্ঘকাল। সৌখীন সে সাংবাদিকতাকেও গণমানুষের পেশাভিত্তিক সাংবাদিকতা হিসেবে গড়ে তুলতে এতোদাঞ্চলে যারা কাজ করেছেন বৈঠকখানা থেকে মাঠে-ময়দানে, তাদেরও একজন ছিলেন সৈয়দ মতিউর রহমান নামের এই মানুষটি। মৌলভীবাজারের রাজনীতি ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে আমার প্রিয় মানুষদের একজন।
মতিউর ভাইয়ের সাথে আমার রাজনৈতিক কোন সম্পর্ক ছিল না। আমি ছাত্রলীগ থেকে এসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে শরিক হই এবং আজও ওই দলেরই একটি অংশের সাথে আছি। কিন্তু কেনো জানি মতিউর ভাইকে আমার খুব ভাল লাগতো। আমার এই ভাল লাগার মধ্যে কোন ভয়-ভীতি ছিল না কিংবা কোন প্রাপ্তিযোগও ছিল না। তাকে দেখে মনে হতো একজন সত্যিকারের ভাবুক ও রাজনীতিক। একজন প্রথম কাতারের সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও তাকে কোনদিন আমি পুলিশের সাথে অরাজনৈতিক সম্পর্ক নির্মাণ বা আমলাদের দালালিতে দেখিনি। মুগ্ধ হওয়ার মত ছিল তার বিনয়ী স্বভাব। সাংবাদিকতায় তাকে একজন নিবেদিত প্রান সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি। এসকল চারিত্রিক গুণাবলীর কারণেই তিনি আমার শ্রদ্ধার আসনে স্থান করে নিয়েছিলেন।
ষাট-সত্তুর দশকের সাংবাদিক সমিতির(মফঃস্বল) নেতা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জের শফি ভাইয়ের সাথে তার খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। শফিভাই খুব ঘন ঘন তখন মৌলভীবাজার আসতেন মতিউর ভাইয়ের কাছে। সাংবাদিকতা আর প্রেসক্লাব নিয়েই তাদের যত আলাপ-আলোচনা হতো। এই শফি ভাইয়ের সাথে মতিউর ভাই-ই আমায় পরিচয় করিয়ে দেন। শফিভাইয়ের পরিচয়ের পথ ধরে পরে ১৯৮২ সালের দিকে আমি বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির জাতীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক হবার গৌরব অর্জন করেছিলাম।
আজ মনে হয় সৈয়দ মতিউর রহমান সত্যিকার অর্থেই একজন খাঁটী দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাকে দেখেছি একজন বলিষ্ট নীতিবান সাংবাদিক হিসেবে। পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক আপোসহীন রাজনীতিক। সম্ভবতঃ তার চরিত্রের বলিষ্ট এ দিকগুলোই আমাকে মনের দিক থেকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতাম।
মতিউর ভাই, শওকত ভাই, সুনির্মল কুমার দেব মীন, গজনফর আলী চৌধুরী কিংবা রাধিকামোহন গোস্বামী মহোদয়, তাদের সামনে কখনও ধূমপান বা অনৈতিক কোন কিছু করিনি। অসৌজন্যমূলক কোন ধরনের আচরণ এদের সামনে ভুলক্রমেও সংগঠিত হয়নি। সাংবাদিকতার সূত্রে তার চেয়ে বেশী ঘনিষ্ট ছিলাম প্রয়াত সাংবাদিক শফকতুল ওয়াহেদের সাথে। অথচ মতিউর ভাই আমাকে অকৃত্তিম স্নেহ করতেন।
প্রেসক্লাবের বারান্দায় এভাবে বসে থাকা ছিল সংবাদ বিষয় নিয়ে চিন্তামগ্নতার এক শৈল্পিক প্রকাশ মতিউর ভাইয়ের। সবসময় না হলেও মাঝে মধ্যে এভাবে দেখতাম। তারপর হঠাৎ কিছুদিন আর দেখা হতো না। বুঝতাম দলীয় কাজে কিংবা সাংবাদিকতার কাজে কোথায়ও গিয়েছেন। আবার কিছুদিন পর দেখতাম সৈয়দ মতিউর রহমান বারান্দায় বসে কিছু লিখছেন।
রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারনে মূলতঃ তাকে থাকতে হতো মৌলভীবাজারে। নিজের পছন্দসই লেখা-লেখির সময় নিঃসঙ্গ অন্তরঙ্গ পরিবেশের খুঁজে প্রেসক্লাবের একটি কক্ষে মাঝে মাঝে থাকার ব্যবস্থা করতেন। আর তখনই তাকে সকালে দেখা যেতো প্রেসক্লাবের বারান্দায় বসে কিছু লিখছেন। প্রেসক্লাবের ‌ওই কক্ষে বহুদিন থেকেছেন সাংবাদিক আব্দুস সালাম।
ন্যাশনেল আওয়ামী পার্টির রাজনীতি আর সাংবাদিকতা এ দুই নিয়েই ছিলেন সৈয়দ মতিউর রহমান। যতটুকু মনে পড়ে ১৯৭২-৭৩ সনে মৌলভীবাজার মহকুমা ন্যাপের তিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মতিউর রহমানের ঘনিষ্টজনদের মাঝে অনেকেই আজ আর নেই। তাদের মধ্যে আমার দেখা অন্যতম ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক রাজনীতিক বাহারমর্দনের শফকতুল ওয়াহেদ, প্রয়াত সমাজসেবক, রাজনীতিক ও সাংবাদিক ঢেউপাশার রাধিকা মোহন গোস্বামী; রাজনগরের কম্যুনিস্ট নেতা প্রয়াত তারা মিয়া, মৌলভীবাজার আমতৈল ইউনিয়নের ন্যাপ নেতা আব্দুল জলিল, বাসুরিয়ার ন্যাপ নেতা প্রয়াত মাখন লাল দাস(অতীতের শিশির ষ্টুডি‌ও’র কাছে তার ভুষিমালের একটি দোকান ছিল), প্রয়াত সাংবাদিক রাজনীতিক বেকামুড়ার গজনফর আলী চৌধুরী; স্বাধীনতা পরবর্তী মৌলভীবাজার সাধারণ পাঠাগারের পাঠাগারিক প্রয়াত সাংবাদিক রাজনীতিক বোরহান উদ্দীন খান প্রমুখ ব্যক্তিবৃন্ধ। তাদের মধ্যে এখনও বেঁচে আছেন মৌলভীবাজারের আরেক কীর্তিমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যশিল্পী, রাজনীতিক অধ্যক্ষ সুনির্মল দেব মীন।
সৈয়দ মতিউরের সাহচর্য্যে মৌলভীবাজারের সাংবাদিকতায় ও রাজনীতিতে যে কয়েকজন গড়ে উঠেছেন, যাদের অনেকেই আমাদের গর্ব, তাদের প্রথমেই যার নাম বলতে হয় তারই ভাগনেয় বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পাটির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট রাজনীতিক সৈয়দ আবু জাফর আহমদ। মৌলভীবাজারের সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের আরেক পথিকৃৎ। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে যিনি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের স্থানীয় বাতিঘর হয়ে কাজ করেছেন এবং এখনও নিরলস নিষ্কলুস কাজ করে যাচ্ছেন সকল লোভনীয় ব্যক্তিগত বাসনার উর্দ্ধে থেকে। আবু জাফর দীর্ঘকাল সাপ্তাহিক মনুবার্তার সম্পাদনা ও প্রকাশনা করেছেন। তিনি মনুবার্তার প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন।  আবু জাফরকেও তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কোনদিন পুলিশ ও আমলা রাজনীতির সঙ্গী হতে দেখিনি। এ সবই মামা সৈয়দ মতিউর রহমানের প্রত্যক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ নির্লুভ প্রভাবের অনুসরণ থেকে বিকশিত।
মৌলভীবাজারের বর্তমান আওয়ামীলীগ নেতা একসময়ের ছাত্রইউনিয়ন নেতা আলাউর রহমান চৌধুরীসহ এমন অসংখ্য নেতাকর্মী জীবিত আছেন এবং রাজনীতিতেই আছেন, যাদের অনেকের রাজনীতিতে হাতেখড়ি সৈয়দ মতিউর রহমানের কাছে। বর্তমানে প্রবাসে অবস্থানরত বিশিষ্ট কম্যুনিষ্ট নেতা মসুদ আহমদও তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে গড়ে উঠা একজন চৌকুস রাজনীতিক।
মৌলভীবাজারের সাংবাদিকতায় যিনি যথেষ্ট সুনামের অধিকারী সাংবাদিক আব্দুস সালামও প্রত্যক্ষভাবে তারই হাতে গড়া মানুষ। এই ছিলেন সৈয়দ মতিউর রহমান।
সৈয়দ মতিউর আমাদের ভঙ্গুর সমাজকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছুই। যা করেছেন সবই নৈতিক দায়ীত্ববোধ থেকেই করেছেন। কিন্তু আমরা কি দিতে পেরেছি বিনিময়ে? এখনই ভাববার উপযুক্ত সময়। মানুষকে তার উপযুক্ত যোগ্য সম্মানে বরণ করে নেয়া সুশীল সভ্য সমাজের নীতি দায়ীত্বের বিষয়। এ বিশ্বের কেউই সমাজের কাছে নিজেদের কৃতকর্মের বিনিময় দাবী করেনা। কিন্তু বিদগ্ধ সুশীল সমাজ তাদের নৈতিক দায়ীত্ববোধ থেকে আর নতুনকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়াতদের স্মরণার্থে কিছু করে যায়।  মৌলভীবাজারে সে সুশীল সমাজ এখনও পূর্ণতা না পেলেও এটুকু উপলব্দিতে নেয়ার বয়স অবশ্যই তাদের হয়েছে। এবং আমরা  তাই মনে করি।
মতিউর ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই। পরপারে চির জনমের মত চলে গেছেন। আর কোনদিন তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। বলতে পারবেন না, তোমরা আমাকে এভাবেই ভুলে গেলে!
সৈয়দ মতিউর রহমান মৌলভীবাজারের সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক অঙ্গনের এক কিংবদন্তী। কমলগঞ্জের পতন উষার ধন্য এমন কীর্তিমান মানুষকে জন্ম দিয়ে।

এ জাতীয় সংবাদ

তারকা বিনোদন ২ গীতাঞ্জলী মিশ্র

বাংলা দেশের পাখী

বাংগালী জীবন ও মূল ধারার সংস্কৃতি

আসছে কিছু দেখতে থাকুন

© All rights reserved © 2021 muktokotha
Customized BY KINE IT