প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যরে অপার লীলাভূমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজি অটো ও বাস নিয়ে আসা পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। উপজেলার টিলাঘেরা সবুজ চা বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জিসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে যেন পা ফেলার ঠাই নেই।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের টিকিট কাউন্টার থেকে জানা যায়, ঈদের দিন শনিবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১শত ৩৩টাকা ও ঈদের পরের দিন রোববার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লক্ষ ২০হাজার ৩শত ৭১টাকা। সোমবার দুুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। এখানে প্রাপ্ত বয়স্ক, ছাত্র-ছাত্রী ও বিদেশী পর্যটক ছিল।
এদিকে ঈদের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনেও ঈদ উপলক্ষে পিকআপ ভ্যান, জিপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টমটম ও মোটরসাইকেলে করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘুরে দেখা গেছে অনেক তরুণদেরক। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ তাঁদের আটকে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচলে নিরুৎসাহিত করছে।
অন্যদিকে দেখা যায় কমলগঞ্জ থানার দায়ীত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) সঞ্জয় চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পর্যটক নগরী কমলগঞ্জে প্রতিটি জায়গায় পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ঘুরে থাকতে দেখা যায়।
জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, পদ্মকন্যা নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, ঝর্ণাধারা হামহাম জলপ্রপাত, ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ধলই চা বাগানে অবস্থিত মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাহক বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য রাজকান্দি বন, শমসেরনগর বিমানবন্দর, প্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক লক্ষ্মীনারায়ণ দিঘী, ২শ বছরের প্রাচীন ছয়চিরী দিঘী, শমশেরনগর বাঘীছড়া লেক, আলীনগর পদ্মলেক, মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাসফিল্ড, ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, অপরূপ শোভামন্ডিত উঁচু নিচু পাহাড়বেস্টিত সারিবদ্ধ পদ্মছড়া চা বাগান, শিল্পকলা সমৃদ্ধ মণিপুরি, প্রকৃতির পূজারী খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, মুসলিম মণিপুরি, টিপরা ও গারোসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবন ধারা ও সংস্কৃতিসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই জনপদ পর্যটকদের মন ও দৃষ্টি কেড়ে নেয়। টানা ছুটিতে এসব আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
সোমবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে মাধবপুর লেক ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেখা মিলে দুর দুরান্ত থেকে আগত পর্যটনপ্রেমী ভ্রমণ পিয়াসুদের। এদের মধ্যে স্বপরিবারে ঘুরতে আসা পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ঈদের দিন শনিবারের চেয়ে ও রোববার পর্যটকের উপস্থিতি ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও পর্যটকরা ছুটে এসেছেন জীব বৈচিত্র্য্যের অপরূপ সমাহার ঘুরে দেখতে। কমলগঞ্জের মাধবপুর চা বাগান ও পদ্মছড়া নয়নাভিরাম মনোরম দৃশ্য পাহাড়ি টিলার উপর সবুজ চা বাগানের সমারোহ, জাতীয় ফুল দূর্লভ বেগুনী শাপলার আধিপত্য, ঝলমল স্বচ্ছ পানি, ছায়া নিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি আনন্দের বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। লেকে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
এছাড়া ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, শমশেরনগর বাগীছড়া লেক, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধসহ কমলগঞ্জের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। তবে, ঝর্ণাধারা হামহাম জলপ্রপাতে পর্যটকদের ভিড় কিছুটা কম ছিল। ভিড় কম থাকার কারণ হিসেবে জানা যায়,পানি কম তাছাড়া, হামহাম জলপ্রপাতে ভ্রমণ করতে পুরো একদিনের প্রয়োজন। আর অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু ঈদে বিভিন্ন ইভেন্টে ভ্রমণপ্রেমী পর্যটকরা আসছেন হামহাম জলপ্রপাত দেখতে। তাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশী।
ঈদের ছুটিতে লাউয়াছড়ায় জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে আসা ঢাকা থেকে চাকুরীজীবী মফিজ আলী ও নরসিংদীর গার্মেন্টসকর্মী রিবা বেগম, সিলেট মদনমোহন কলেজ ছাত্র শাহীন আহমেদ, হবিগঞ্জের গৃহিণী মরিশম বেগম, সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রী সবিতা বেগম জানান,‘কমলগঞ্জের লাউয়াছড়ার বন একটি সমৃদ্ধ বন। প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য্য আর জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বনটি যে কেউ দেখলে মন জুড়িয়ে যাবে।’
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, মাধবপুর লেকে ও লাউয়াছড়া ঘুরতে আসা সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী প্রিয়াঙ্গার সাথে কথা বললে তিনি জানান, এখানে এসে আমার খুবই ভালো লাগছে। আব্বু আম্মুর সাথে ঘুরতে এসেছি। বানরের লাফালাফি দেখেছি। বড় একটা ব্যাঙের ছাতা দেখেছি (ব্যাঙের ছাতার আদলে তৈরি মানবছাতা)। এখানে এত গাছ, একসাথে এত গাছ এর আগে দেখিনি। তাছাড়া হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ যাদুঘড় ও লেকের পানি কি বলবো সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছে। মন চাচ্ছে না যেতে। যেকোন ছুটি পেলে আবার আসবো।
লাউয়াছড়া ইকো টুরিস্ট গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. আহাদ মিয়া বলেন,‘ঈদের ছুটিতে লাউয়াছড়াসহ সব পর্যটনকেন্দ্রে প্রচুর পর্যটকের আগমন হয়। ঈদের দিন পর্যটকের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো ছিল। কিন্তু ঈদের পরের ৭দিন পযন্ত পর্যটক বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।’
কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন,‘ আমি সকাল থেকেই কমলগঞ্জের সকল পর্যটন এরিয়া আমাদের থানা পুলিশের একটি টীমকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি। কারণ ঈদ আসলেই পর্যটকের ঢল নামে কমলগঞ্জে তাই নির্বিঘেœ পর্যটকরা ঘুরতে পারে সেইজন্য আমরা তাদের নিরাপত্তার জন্য পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি আরও বলেন, সকলের নিরাপত্তার জন্য কমলগঞ্জ থানা পুলিশ সবসময় সকলের পাশে আছে এবং থাকবে।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, ‘এ ঈদের অন্যান্য সময়ের তুলনায় পর্যটকের সমাগম অধিক ঘটেছে। তবে ঈদে পর্যটকদের উপস্থিতি সব সময়েই বেশি হয়ে থাকে। তিনি বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ করার জন্য পায়ে হাঁটার তিনটি ট্রেইল পথ রয়েছে। দর্শনার্থীরা এই ট্রেইল ঘুরেই চলে যান। এখানে গাইডরাও রয়েছে, এদের বলে দেওয়া হয়েছে যাতে পর্যটকরা এর বাইরে ও কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাতে বন ও পরিবেশের ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে। পর্যটকদের জন্য নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কমলগঞ্জ থানা পুলিশ, পর্যটন পুলিশ ও সিএমসি সদস্যদের নিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও প্রকৃতি ভ্রমণ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি।’