চাঁদপুর থেকে নিকোলাস বিশ্বাস।। বাংলাদেশ সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ(২য় পর্যায়) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে- গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) এবং গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬। এ আইন বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিশেষ ক’রে নারী, দরিদ্র ও অসহায় মানুষ অল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে সঠিক বিচার পাবেন। এ প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, সচিব ও গ্রাম পুলিশদের গ্রাম আদালত বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গ্রাম আদালত বিষয়ক উঠান-বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
আমরাও মনে করি গ্রামীণ আদালত কর্য্যক্রমটি, শহরে আসার জন্য গ্রামীণ সুদকুরদের কাছ থেকে উচ্চহারে ঋণ গ্রহন করা থেকে নিরীহ সাধারণ মানুষ রেহাই পাবে। দ্বিতীয়তঃ গ্রামে থেকেই নিখরচায় আইনী সহায়তায় নিজেদের সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবে। এতে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়বে, দেশ উপকৃত হবে। তৃতীয়তঃ গ্রামীণ দালালদের দৌরাত্ম উল্লেখযোগ্যহারে কমে যাবে। এতেও মানুষ ও সরকার উভয়ই উপকৃত হবেন। -সম্পাদক
এ দফায় গ্রাম আদালত বসেছিল যে নালিশ নিয়ে-
মামলার আবেদনকারী: মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার। বয়স আনুমানিক ৩৫। গ্রাম- সোনাকান্দা, ইউনিয়ন- দৌলতপুর, উপজেলা- দাউদকান্দি, জেলা- কুমিল্লা। ৪ বোন ও বাবা মা সহ মোট ৬ জনের সংসার। পেশায় একজন কিন্ডার গার্টেন স্কুল শিক্ষক। তাঁর বাবা একজন দিনমজুর ও মা গৃহিনী। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি টিউশনি করেন। তার মা বাড়ির কাজের পাশপাশি বিভিন্ন হাতের কাজ করে থাকেন। যেমন- কাঁথা সেলাই, মোড়া তৈরী, কুলা ও ডালা তৈরী ইত্যাদি।
মামলার প্রতিবাদীর পরিচিতি: মোঃ সুফি আহাম্মদ (রনি), গ্রাম- পাটন, ইউনিয়ন- নায়েরগাঁও দক্ষিণ, উপজেলা- মতলব দক্ষিণ, জেলা- চাঁদপুর। তিনি সৌদি-আরব প্রবাসী।
বিরোধের সূত্রপাত: আবেদনকারী ও প্রতিবাদী সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। আবেদনকারী মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার প্রায় ২ বছর পূর্বে প্রতিবাদী মোঃ সুফি আহাম্মদ (রনি) কে, তার বাবাকে বিদেশ নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। রনি তাকে বলেন যে, বিদেশ যেতে হলে প্রথমে পাসপোর্ট করতে হবে। আরিফা তার কথায় রাজি হয়ে বাবার জন্য পাসপোর্ট করে রনিকে জানায়। রনি সৌদি-আরব থেকে আরিফাকে ২০,০০০ (বিশ হাজার) টাকা দিতে বলে। রনির কথা মতো আরিফা ২০,০০০ (বিশ হাজার) টাকা দেয়। এরপর রনি ভিসা প্রস্তুত হয়েছে বলে আরো ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা চান এবং তার বাবাকে কিছু দিনের মধ্যেই বিদেশে নিয়ে যাবে বলে তাকে জানায়। আরিফা রনির কথা মতো আরো ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা দেয়। কিন্তু রনি তার বাবাকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে টাল-বাহানা শুরু করে। এভাবে প্রায় ২ বৎসর পার হয়ে যায়। বিদেশে নিচ্ছেও না আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। এরপর রনি গত ০৪/১১/২০১৮ তারিখে বাংলাদেশে আসে। আরিফা বিষটি জানতে পেরে তার বাবাকে সাথে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রনির সঙ্গে দেখা করে তার টাকা ফেরত চান। কিন্তু রনি টাকা ফেরৎ দিতে অস্বীকার করেন।
আরিফা আক্তার বিষয়টি রনির সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের এক ইউপি সদস্যকে জানান। বিষয়টি শুনে ইউপি সদস্য আরিফাকে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেন। আরিফা উক্ত ইউপি সদস্যের মাধ্যমে আরো জানতে পারেন যে, তাদের ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং সেখানে মামলা করলে ন্যায়-বিচার পাওয়া যায়। মামলার জন্য মাত্র ১০ টাকা অথবা ২০ টাকা ফি দিতে হয়। এই আদালতে কোন আইনজীবি নিয়োগ করা লাগে না। মামলার খরচ খুবই কম হওয়ায় মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার রনির ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে সরাসরি গ্রাম আদালতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন।
গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের: ইউপি সদস্যের কথা মতো, আরিফা ৫/১২/২০১৮ তারিখে রনি’র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং গ্রাম আদালত সহকারী রিমা আক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। আরিফা তাকে বিষয়টি বিস্তারিত বলেন। বিষয়টি গ্রাম আদালতের আওতাভূক্ত বিধায় রিমা আক্তার তাকে গ্রাম আদালতে অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দেন। ঐ দিনই আরিফা আক্তার ২০ টাকা ফি প্রদান সাপেক্ষে গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করেন।
গ্রাম আদালতের বিচার প্রক্রিয়া: আদালত সহকারী রিমা আক্তার দাখিলকৃত অভিযোগটি সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুস সালাম মৃধা অভিযোগটি গুরুত্ব সহকারে দেখেন এবং আদালত সহকারীকে ১১/১২/২০১৮ তারিখে দিন ধার্য করে প্রতিবাদীর প্রতি সমন জারী ও আবেদনকারীকে মামলার স্লিপ দেওয়ার নির্দেশ দেন। আদালত সহকারী যথানিয়মে গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে সমন জারী ও মামলার স্লিপ প্রদান করেন।
নির্ধারিত তারিখে আবেদনকারী ও প্রতিবাদী আদালতে উপস্থিত হন এবং হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। এরপর তারা উভয়ই ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুস সালাম মৃধার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিবাদী চেয়ারম্যানের নিকট ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) টাকা নেওয়া কথা অকপটে স্বীকার করেন এবং ঐদিনই চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ২০,০০০ (বিশ হাজার) টাকা আবেদনকারীকে প্রদান করেন। আর বাকি ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা প্রদানের জন্য চেয়ারম্যানের নিকট ৬ দিনের সময় প্রার্থনা করেন। চেয়ারম্যান প্রতিবাদীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে এবং আবেদনকারীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে তার জন্য মোট ৬ দিনের সময় মঞ্জুর করেন।
৬ দিন পর অর্থ্যাৎ ১৭/১২/২০১৮ তারিখে প্রতিবাদী মোঃ সুফি আহাম্মদ (রনি) মামলার দাবীকৃত অবশিষ্ট ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং চেয়ারম্যানের সাক্ষাতে আবেদনকারী মোসাম্মৎ আরিফা আক্তারকে বুঝিয়ে দেন। এরপর উভয়ে আদালতের নির্ধারিত আপোষনামা ফরমে স্বাক্ষর করেন। এভাবে সংঘঠিত অপরাধ ইউপি চেয়ারম্যানের সামনে স্বীকার করা ও শতভাগ দাবী মিটিয়ে দেওয়ায় মামলাটি গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬ -এর বিধি ৩১ অনুযায়ী নিস্পত্তি হয় এবং প্রয়োজনীয় সকল নথি সংরক্ষণের আদেশ তামিল হয়।
আবেদনকারীর প্রতিক্রিয়া: আবেদনকারী মোসাম্মৎ আরিফা আক্তার স্বল্প সময়ে এবং অল্প খরচে সহজেই ন্যায়-বিচার পেয়ে গ্রাম আদালতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, “গ্রাম আদালত থাকায় আমি খুব সহজে আমার পাওনা টাকা আদায় করতে পেরেছি। আমি কখনো ভাবিনি যে, আমার ইউনিয়নের বাইরে অন্য ইউনিয়নে মামলা দায়ের করে এরূপ ন্যায়-বিচার পাব।” একজন নারী হিসেবে আমি যখন উক্ত গ্রাম আদালতে যাই তখন সেখানেও আমি আদালত সহকারী হিসেবে একজন নারীকে পাই যা আমাকে আরো আশাবাদী করে তোলে। শুধু তাই নয়, আমি আদালত সহকারীর কাছে আমার বিরোধের বিষয়টি অতি স্বাচ্ছন্দে বলি এবং তিনিও মনযোগ সহকারে আমার কথা শোনেন। তিনি এই আশাবাদ ব্যাক্ত করেন যেন গ্রাম আদালত স্থায়ীভাবে এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
বিচারিক-সেবা মূল্যায়ন: হিসেব অনুযায়ী এক দিনের মধ্যেই মামলাটি নিস্পত্তি হয় এবং ৬ দিনের মধ্যে মামলার আদেশ শতভাগ বাস্তবায়িত হয়। মামলাটির জন্য আবেদনকারীকে মোট ৩ বার আদালতে আসতে হয়েছে। এরমধ্যে, মামলা দায়েরের জন্য একদিন, মামলায় হাজিরার জন্য একদিন এবং দাবীকৃত টাকা গ্রহণের জন্য আরো একদিন তাকে আদালতে আসতে হয়েছে। বিচার পাবার জন্য মামলার ফিস বাবদ আবেদনকারীর খরচ হয়েছে মাত্র ২০ (বিশ) টাকা যেহেতু মামলাটির ধরণ দেওয়ানী প্রকৃতির। তাই বলা যায় যে, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য অতি সহজে ও স্বল্প সময়ে ন্যায়-বিচার পাওয়ার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে চাঁদপুরের গ্রাম আদালতগুলো।