দার্শনিক দায়োজেনিস
আসলে জ্ঞানীগুণিজন এমনই হয়। দার্শনিক দায়োজেনিসের জীবনের ঘটনা পঞ্জির দিকে নজর দিলে তাই অনুভুত হয়। অনেকেরই কাছে তা হাসির খোরাক হতেই পারে।
|
ভাববাদী আর বস্তুবাদী গুরু-শিক্ষক প্লেটো-এরিস্টটলদের আমলে তাদের রাষ্ট্র নির্মাণ চিন্তার বিরোধীতা যে ক’জন চিন্তাবিদ করেছিলেন তাদেরই একজন ছিলেন দার্শনিক ডায়োজেনিস। প্লেটো-এরিষ্টটল দু’জনই ছিলেন ঈশ্বরবাদী। তবে এরিষ্টটল ছিলেন ঈশ্বর চিন্তায় বিশ্বাসী একটু বেতিক্রমি বস্তুবাদী। তাদেরই চিন্তার বিপরীতে যিনি ছিলেন খড়গ হাতে নিয়ে সে মহর্ষির নাম ছিল ডায়োজেনিস। সিনোপের ডায়োজেনিস বলেই বিশ্ব ইতিহাসে তিনি খ্যাত। কেউ কেউ দিওগেনেস বা দায়োজেনিস ও বলে থাকেন। এটি ভাষা ও সংস্কৃতিগত উচ্চারণ সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। এমনতর সমস্যা কোনদিনই কোন জ্ঞানীদ্বারা সমাধান করা সম্ভব নয়। বিশ্বের সকল ভাষা ও সমাজে এমন সমস্যা রয়েছে এবং থাকবেই। তাকে নিয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলায় লিখতে গিয়ে আমি তাকে দায়োজেনিস বলেই উল্লেখ করতে বেশী সাচ্ছ্যন্দবোধ করবো। |
মহর্ষি দায়োজেনিসের জন্ম যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৪১২বছর আগে মতান্তরে ৪০৪বিসি’তে বর্তমান তুরস্কের সিনোপ-এ। সিনোপ কৃষ্ণ সাগর উপকূলে তখন একটি আইওনিয়ান উপনিবেশ ছিল যা এশিয়া মাইনর খ্যাত আনাতোলিয়া নামে পরিচিত ছিল। দায়োজেনিস, যিনি ডায়োজেনিস দ্য সিনিক নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন গ্রিক দার্শনিক এবং সিনিক দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বহুল আলোচিত চরিত্র। তার বাবা ছিলেন গ্রীসের সরকারী মুদ্রাতৈরীকারক। তিনি শহরের মুদ্রা তৈরীর কারখানায় কাজ করতেন। বাবার সাথে দায়োজেনিসও কাজ করতেন। মুদ্রার মান নষ্ট করার কারণে দায়োজেনিসকে বহিষ্কার করা হয়। অনেক গবেষকের ধারণা অপকৃষ্টতার মাধ্যমে মুদ্রার অবমূল্যায়ন মূলতঃ তার বাবাই করতেন। কিন্তু বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে দায়োজেনিস নিজেই এ দায় নিজের উপর নিয়ে শাস্তি মেনে নেন। |
এর পরে এক সমুদ্র যাত্রায় জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে এবং কোরিন্ত-এ দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এই সমুদ্রযাত্রা ও দাস হিসেবে বিক্রি ঘটনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন মুদ্রার মান নষ্ট করার কারণেই তাকে শহর থেকে বের করে দেয়া হয় এবং দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে ওখানে ওই কোরিন্ত-এ-ই তিনি তার বাকী জীবন অতিবাহিত করেন এবং তার আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্বতা পালনমূলক দর্শনের প্রচার করেন। তিনি মনে করতেন জীবনের স্বার্থকতা ভোগে নয় বরং ত্যাগে এবং কৃচ্ছ্বতাসাধনে, কষ্টভোগে। তিনি ছিলেন একজন সিনিক বা উদাসীনতাবাদী মানুষ। |
|
জ্ঞান হলো খারাপ কাজের কুফল সম্পর্কে জানা। আর প্রজ্ঞা হলো খারাপ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা। তাই বলা যায়, প্রজ্ঞা সেটাই যা বুঝতে সাহায্য করে জীবনে কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন নয়। বিজ্ঞজনেরা বলেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেকোন কিছুই বিষ। এমন কথার যথাযথ প্রয়োগ আমরা যদি কারো জীবনে পেয়ে থাকি সেটা সম্ভবত দার্শনিক দায়োজেনিসের জীবন দর্শনেই খুঁজে পাই।
কাহিনী আছে, দায়োজেনিসের ‘আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্বতা পালনমূলক দর্শন’এর খবরে ও তার অবাক করা অভিনব সব কর্মকাণ্ডের খবরে বীর আলেকজান্ডার ঠিক করলেন তার সাথে দেখা করবেন। লোকলশ্কর নিয়ে একদা আলেক্জাণ্ডার দায়োজেনিস যেখানে থাকতেন সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। দেখলেন দায়োজেনিসের আবাস হলো পরিত্যাক্ত বিশাল একটি টব বা মদের ভাড়। তিনি সামান্য কাপড় পরে আছেন, দেখতে পাগল ধরণের। অবস্থা দেখে আলেকজান্ডার বিমোহিত হলেন। তার খুব ইচ্ছে হলো মানুষটির সাথে আলাপ করার।
দায়োজেনিসের সামনে গিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, “আমি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।”
দায়োজেনিস না তাকিয়েই অনেকটা অবাককরা উত্তর দিলেন। বললেন, “আমি দায়োজেনিস দ্য সিনিক।”
আলেকজান্ডার অবাক হলেন। বললেন, “আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন না?”
দায়োজেনিস বললেন, “কেন? আপনাকে ভয় পেতে হবে কেন? আপনি ভালো না খারাপ?”
আলেকজান্ডার বললেন, “অবশ্যই ভালো।”
দায়োজেনিস বললেন, “তো ভালো জিনিসকে কি মানুষ ভয় পায় না-কি?”
দায়োজেনিসের এমন উত্তরে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আলেকজান্ডার। কেনো জানি আলেকজান্ডার তার সঙ্গীসাথীদের উদ্দেশ্য করে বললেন – “আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে দায়োজেনিস হতে চাইতাম!” আলেকজান্ডারের এমন কথায় দায়োজেনিস একটুও উৎসাহ না দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন- “আমি যদি দায়োজেনিস না হতাম তা’হলে দায়োজেনিস হতেই চাইতাম।”
সেদিনের আলাপচারিতায় আলেকজাণ্ডার এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে এরপর থেকে তিনি নিয়মিত আসতেন দায়োজেনিসের কাছে।
অন্য একদিন আলেকজাণ্ডার যখন দেখতে গেলেন, আলাপের সময় দায়োজেনিস আলেকজান্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?” আলেকজান্ডার বললেন, “সমস্ত গ্রীস নিজের আয়ত্তে আনা।”
দায়োজেনিস আবারো জানতে চাইলেন, তারপর কি করবে?
আলেকজান্ডার উত্তর করলেন, সমস্ত এশিয়া মাইনর নিজের আয়ত্তে আনবো।
দায়োজেনিস আবারও জানতে চাইলেন- তারপর কি?
আলেকজাণ্ডারও উত্তর দিলেন- সমস্ত পৃথিবী নিজের আয়ত্তে আনতে চাই।
দায়োজেনিসের প্রশ্নেরও শেষ হয় না। তিনি ছাড়ার মানুষ নন। তার জবাবের শেষ জানার জন্য আবারও বললেন “তারপর?”
আলেকজান্ডার উত্তর দিলেন, তারপর আর কী! বাড়িতে বসে বসে বিশ্রাম নেবো!
দায়োজেনিস তখন হেসে হেসে বললেন, “এ কাজ তো তুমি এখনই করতে পারো।”
এ কথা শুনে বীর আলেকজাণ্ডার খুশীই হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন লোকটি আসলেই গভীর সত্য চিন্তার মানুষ। মনে মনে তাকে গুরু মেনে নিলেন।
একই নিয়মে অপর একদিন গুরুর জন্য কিছু করার ইচ্ছে হলো আলেকজান্ডারের। দায়োজেনিস তখন তার মদের খালি ভাড়ের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আলেকজান্ডার সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে দায়োজেনিস, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?”
দায়োজেনিস শান্তভাবে বললেন, “তুমি আমার সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়াও! তোমার জন্য আমি রোদ পোহাতে পারছি না!”
|
|
বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা তখন আলেকজান্ডার। এমন ক্ষমতাবান একজন মানুষ নিজ থেকে এসে কিছু দিতে চাইলেন, দায়োজেনিস সে চিন্তাতেই গেলেন না। অতিসহজেই আলেকজান্ডারের কথাগুলো এড়িয়ে গিয়ে বললেন তুমি সরে দাঁড়াও তোমার কারণে আমি রোদ পোহাতে পারছি না! |
একবার ভাবুবনতো কোন মাত্রার মানুষ ছিলেন দার্শনিক দায়োজেনিস। এমন স্বাধীনচেতা দার্শনিক বিশ্ব ইতিহাসে নেই বললে ভুল হবে না। সে সময়ের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজারও তাকে দেবার মতো কিছু নেই। কেননা, রোদ ছাড়া সে মুহূর্তে তার আর কিছুর প্রয়োজন ছিলো না। প্রজ্ঞা তো সেটাই, কী প্রয়োজন আর প্রয়োজন নয় তা জানা। |
আর এক সময় আলেকজাণ্ডার দেখলেন দায়োজেনিস মানুষের হাড়ের এক স্তুপের মাঝে কি যেনো খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলেন কি খুঁজছেন। দায়োজেনিস উত্তর দিলেন- তোমার বাবার হাড় খুঁজছি কিন্তু কি জানো, এই দাসমানুষগুলোর হাড় থেকে তোমার বাবার হাড় আলাদা করার কোন উপায় পাচ্ছিনা।
আলেকজাণ্ডার তার টুপি খুলে তাকে সম্মান দেখিয়ে বলেছিলেন, এ লোকটি কিছু করতে চায় অথবা মরতে চায়।
|
দায়োজেনিস তার জন্ম শহর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তিনি অবশ্য তার জন্য কোনো অনুশোচনা করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাসনই আমাকে দার্শনিক বানিয়েছে’। তাঁকে দাস হিসাবে বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হলে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে এমন কারো কাছে বিক্রি করো যার মনিবের প্রয়োজন।” |
দায়োজেনিস সব সময় যেভাবে পছন্দ করতেন, সেভাবেই চলতেন। কথা বলার অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে সেরা সম্পদ।”
ডায়োজিনিস এই স্বাধীনতা ব্যবহার করেছিলেন গ্রিকদের বিরুদ্ধে, তাদের ভণ্ডামীগুলোকে তিরষ্কার করতে। তাঁকে নিয়ে লেখা এক বইতে বলা হয়েছে, তা’কে বাজারে লন্ঠন হাতে হাজির হতে দেখে- কী করছেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘তিনি আসলে মানুষ খুঁজছেন’। হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজে বেড়ানোর শব্দকল্প কথা এই ঘটনা থেকেই এসেছে। তার সেই ঘটনাটির কাহিনী এরূপ- একবার দিনের বেলা তিনি লণ্ঠন হাতে বাজারে উপস্থিত হলেন। দিনের বেলা বুড়োর হাতে জ্বালানো লণ্ঠন দেখে সবাই বেশ আনন্দচিত্তে তাকে জিজ্ঞেস করলো, “এই ভরদুপুরে লণ্ঠন হাতে কোথায় চললেন?” দায়োজেনিস বললেন, “আমি আসলে মানুষ খুঁজছি। গ্রীসের কোথায় মানুষ পাওয়া যাবে, কেউ বলতে পারবে?”
ধর্ম, খাদ্য, বাসস্থান, পরিধেয় ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে তিনি প্রথার বিরোধী ছিলেন। তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ করতেন মানুষের তৈরী করা সুখচিন্তার প্রচলিত রীতি এবং নিয়মের বিরুদ্ধে। সিনিকরা নৈতিক ক্ষেত্রে সুখবাদ বিরোধী ছিলেন। প্রচলিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং আচারের প্রতি তারা অবজ্ঞা প্রদর্শন করতেন।
দায়োজেনিস প্লেটো, সক্রেটিসের মতের বিরোধীতা করতেন প্রচন্ড বিদ্রুপের সাথে।
প্লেটো তার সম্পর্কে বলেছিলেন, “পাগলাটে হলেও তিনি আর একজন সক্রেটিস”।
|
|
অনেকেই তার বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন যে, যদি নির্বাসন তাকে একজন দার্শনিক বানিয়ে থাকে, এর কারণ নির্বাসন তাকে দারিদ্রের মতো অমূল্য উপহার দিয়েছিল।
একজন একদিন দায়োজেনিসকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আপনি একজন দার্শনিক কিন্তু আপনাকে লোকে ভিক্ষা দেয় না, কিন্তু ভিক্ষুকদের ঠিকই দেয়। এর কারণ কী?”দায়োজেনিস বললেন, “তারা মনে করে একদিন খোঁড়া কিংবা অন্ধ হয়ে ভিক্ষুক হতে পারবে, কিন্তু দার্শনিক তো আর হতে পারবে না, তাই।” |
জীবন চলার পথে দায়োজেনিসকে সবসময়ই ব্যস্ত দেখা যেতো। যখন একেবারে বৃদ্ধ তখনও দায়োজেনিসের এত কিসের ব্যস্ততা, এথেন্সের মানুষ জানতে চায়। এমন এক অবস্থার জবাবে দায়োজেনিস বলেছিলেন- “গোল পোস্টের কাছে এসে কি আমার দৌড় কমানো উচিৎ?” বয়স বাড়ছে বলে আমাদের যে আক্ষেপ তা নিতান্তই গৌণ ছিলো দায়োজেনিসের কাছে। |
অদ্ভুত একজন মানুষ ছিলেন দায়োজেনিস। পোশাক পরতেন যৎসামান্য, থাকতেন রাস্তার ধারে একটা টবে। আমাদের দেশে ড্রেনের বড় পাইপের ভেতর যেমনটি থাকতে দেখা যায়, খানিকটা সেরকম। নিজের সম্পদ বলতে ছিলো শুধু একটা লাঠি, লণ্ঠন, পরনের সামান্য শতছিদ্র কাপড় আর একটা খাবার পাত্র।
খেতেন ভিক্ষা করে। ভিক্ষা করার সময় বলতেন, “তুমি যদি অন্য কাউকে ভিক্ষা দিয়ে থাকো, তবে আমাকেও দাও। আর আজ অব্দি যদি কাউকে না দিয়ে থাকো, তবে আমাকে দিয়ে শুরু করো!”
মাঝে মধ্যে চুরি করতেন বা অন্য কারো জিনিস কেড়ে নিতেন! এমন অভিযোগও তার বিরুদ্ধে ছিল। একসময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো- “আপনি তো প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে বসবাস করেন, তো মানুষের জিনিস কেড়ে নেন কেন?”
উত্তরে দায়োজেনিস বলেছিলেন, “আমি অহেতুক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে বসবাস করি। এ জগতের সমস্ত জিনিস হচ্ছে ঈশ্বরের। আর জ্ঞানীরা ঈশ্বরের বন্ধু। তাই এ জগতের সব কিছুতেই জ্ঞানীদের অধিকার আছে!”
|
একবার দেখা গেল, তিনি এক মূর্তির সামনে দাড়িয়ে সেটির কাছ থেকে ভিক্ষা চাইছেন। লোকে জিজ্ঞেস করলো, “কী ব্যাপার?” দায়োজেনিস বললেন, “প্রত্যাখ্যাত হবার অনুশীলন করছি!” |
দায়োজেনিসকে প্রায়শই ব্যঙ্গ করে কুকুর বলে ডাকা হতো। এতে কোন সময় তিনি বিরক্ত হয়েছেন এমন কোন কথা জানা যায়নি বরং তিনি বলতেন, “অন্য কুকুররা তাদের শত্রুদের কামড়ায় আর আমি আমার বন্ধুদের কামড়াই, তাদের রক্ষা করতে।” |
|
সামাজিক প্রথাকে তিনি আরো অনেকভাবে আক্রমণ করে গেছেন। একবার এক থিয়েটার শেষে সবাই যখন বের হয়ে যাচ্ছিলো, তখন দেখা গেলো দায়োজেনিস থিয়েটারে ঢুকছেন। কেউ একজন বললো, “এখন এসেছেন কেন? থিয়েটার তো শেষ!” তিনি উত্তরে বললেন, “তোমাদের প্রথাকে আক্রমণ করতে এসেছি।” এই বলে তিনি শূন্য থিয়েটারের ভেতরে গিয়ে বসে রইলেন! |
আজও আমাদের এ বিশ্বে আদেখা একজন মানুষ দার্শনিক দায়োজেনিস। তিনি একবার দর্শনের নানা বিষয় কিছু মানুষের সামনে আলোচনা করছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, মানুষেরা ধীরে ধীরে কেটে পড়ছে, তার কথায় তাদের ভাল লাগছে না। তাৎক্ষনিক তিনি তার আলোচনা থামিয়ে নাচতে আরম্ভ করলেন। অমনি আবার সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। তিনি নাচ থামিয়ে বললেন, “বুদ্ধিহীনের দল! ভালো কথায় আগ্রহ নেই, ভাঁড়ামিতে ঠিকই আগ্রহ আছে!” |
দর্শনের এক ছাত্র একবার দায়োজেনিসের কাছে এসে বলেছিলো যে, দর্শনবিদ্যা তার কাছে খুব কঠিন মনে হয়। শুনে দায়োজেনিস বলেছিলেন, “ভালোভাবে বাঁচতে চাও না যখন, বেঁচে আছো কেন?” |
দায়োজেনিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, বিয়ের জন্য সঠিক বয়স কোনটি? দায়োজেনিস বললেন, “একজন যুবকের জন্য এখনও সময় আসেনি, আর বুড়োর জন্য পেরিয়ে গেছে!” |
দায়োজেনিসের কোনো বিলাস দ্রব্য ছিলো না। তিনি একটি পাত্রে পানি পান করতেন। একদিন তিনি এক শিশুকে দেখলেন, জলাধার থেকে হাত দিয়ে পানি উঠিয়ে পান করতে। তখন তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “হায়! একটি শিশু সাধারণ জীবন যাপনে আমাকে হারিয়ে দিলো!” বলেই তিনি তার পাত্রটিকে ছুড়ে ফেলে দেন। |
মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছেন, “আমার মৃত্যু হলে তোমরা আমার শরীরটাকে শহর থেকে দূরে ফেলে রেখে এসো, জন্তু জানোয়াররা যেন তা খেতে পায়।”
তার সব কথাই মূলতঃ সময়কে পেরিয়ে যাওয়া কথা। সেসকল কালোত্তীর্ণ কথার অন্যতম কিছু কথা যেমন-
একজন জ্ঞানীকে আবিষ্কার করতে আরেকজন জ্ঞানীর প্রয়োজন হয়।
তারই সবচেয়ে বেশি আছে, যে অল্পে তুষ্ট।
কুকুর এবং দার্শনিকেরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে, কিন্তু সবচেয়ে কম প্রতিদান পায়।
রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে তার যুবসমাজের শিক্ষা।
ছাত্র খারাপ আচরণ করলে তার শিক্ষককে চাবকানো হবে না কেন?
ঈশ্বর হবার সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো তার কারো কাছে হাত পাতা লাগে না। যারা ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি, তাদের প্রয়োজন তাই খুব সামান্য।
|
|
একজন ধনীর বাড়িতে থুতু ফেলবার কোনো জায়গাই থাকে না! একমাত্র সে ধনীর চেহারা ছাড়া! |
|
দায়োজেনিসের জীবনী সম্বন্ধে আমাদের বেশি কিছু জানা নেই। কেনো দায়োজেনিসের জীবন কাহিনী অন্যান্য দার্শনিকের মত খোঁজে লিপিবদ্ধভাবে পাওয়া যায় না সে উত্তর আমার কাছে নেই। তবে পাওয়া যে যায় না সেটিই সঠিক। |
|
দায়োজেনিস বা অন্য সিনিক চিন্তকেরা মূলত মানুষের জীবনের দু’টি সমস্যার সমাধানের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তা হলো, ১. সব ধরনের উদ্বেগ এবং চিন্তা থেকে মুক্তি, এক শক্তিশালী স্থিরতা। অপরটি হলো- অর্থ ও মনের সেই অবস্থা, যাকে তীব্রতম আবেগও বিচলিত করতে পারে না। সে অবস্থা নির্বিকার নয়, বরং চিন্তাশক্তির স্থিরতায় বিরাজমান প্রশান্তি। |
|
সিনিকগণ বলেছেন, আমাদের শুধুমাত্র অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে প্রকৃতির নিয়মে বাঁচা উচিৎ। এমনকি তারা গাছ থেকে ফল না পেড়ে সামান্য পরিমাণ ডাল খেয়ে বেঁচে থাকতেন। পরনের সামান্য কাপড় আর লাঠি বা চামড়ার থলে ছাড়া তাদের ভিন্ন কোনো সম্পদ থাকতো না। তারা বাস করতেন প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা কোনো আবাসে, তাদের মালিকানায় কোনো আরামদায়ক আবাসও ছিলো না। তারা বলতেন, এমন জীবনধারণই চরম প্রশান্তি এনে দিতে পারে। |
অবশ্য আমাদের এই অত্যাধুনিক জীবনে সিনিকদের মতো এমন নির্লোভ, সাদাসিদে কিন্তু স্বাধীনভাবে বসবাস করা সম্ভব কিনা? সে এক কঠিন প্রশ্ন।
বর্তমান সময়ে, যেখানে মানুষ কেবল যশ খ্যাতি এবং ঐশ্বর্যের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলেছে, যেখানে মানুষের বিলাসিতার চাদরে মোড়ে থাকার প্রবণতা বেড়েছে; সেখানে দায়োজিনিস দ্য সিনিক হতে পারেন আমাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর প্রজ্ঞার এমন সুচারু ব্যবহার এবং নির্মোহ জীবনযাপন থেকে শিক্ষা নেয়া যেতেই পারে। তিনি তাঁর উদ্ভট উদ্ভট কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে সহজ উপায়ে মানুষদেরকে বাস্তব জীবনের শিক্ষা দিয়েছেন।
|