হারুনূর রশীদ।। ধনবানরা রাজ্যপাট চালাতে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য, ক্ষেত্র বিশেষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অনন্য সাধারণ কর্মকান্ড দেখাতে খুবই সচ্চেষ্ট থাকে। যে যত বেশী অদ্ভুত অদেখা কাজ দেখাতে পারে সে ই ততবড় নেতা। রাজনীতিতে, তারাই শেখায়, এই বলে যে নেতাকে ‘কেরিশমেটিক’ হতে হবে। মানুষ চায় বা না চায়, সমাজের প্রয়োজন থাক বা না থাক নেতাকে বজ্রকন্ঠে বলতে হবে-“আমি এই করে দেবো, সেই করে দেবো”। তিনি না পারিলেও তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। নেতা যত আজগুবি কাজ-কর্ম দেখাতে পারবেন, মানুষ তাদেরকে ততবেশী প্রশংসা করবে এবং সমর্থন করবে, এই তাদের ধারণা। দুনিয়াব্যাপী ধনবানদের রাজনীতির রূপ এরকমই।
ধনবাদী বৃটেনের রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটে থাকে। একবার, মানুষের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো এই বলে যে আর মনে হয় রাজতন্ত্র টিকে থাকতে পারবে না। খুব সম্ভবতঃ শ্রমিক দল তখন ক্ষমতায়। রাজকুমারী এ্যান গাড়ী চালিয়ে এক সভায় যাচ্ছেন। গাড়ী একটু দ্রুত গতিতে চালাচ্ছেন। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ আটকালো। ভাব-সাব এমনই যে সে রাজকুমারীকে মোটেই চেনে না। রাজকুমারীকে কয়েক শ’ত পাউন্ড জরিমানা দিয়ে ছাড় নিতে হল। পরের দিনই ধনবানদের সংবাদপত্র রাজকুমারীর গুণে মুগ্ধ হয়ে গুণকীর্তন করে সংবাদ পত্রের পাতা ভরালেন।
ঠিক আর এক দফায় দেখা গেল, টনি ব্লেয়ার ট্রেনে যাচ্ছেন অফিস করতে। মিথ্যা অজুহাতে ইরাকের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে সমস্ত দুনিয়াকে আজ যে এক ভয়াবহ সংকটের আবর্তে রেখে দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে গেছেন যিনি, সেই টনি ব্লেয়ার ট্রেনে যাচ্ছেন, তাও দাঁড়িয়ে! হটকারিতা আর কাকে বল! আর এসব নমুনার ‘কেরিশমা’ দেখাবার সময়টা বেঁচে নেয়া হয় নির্বাচন কিংবা কোন সংকটকালের সময়কে।
ওই যে কথায় আছে না, দীর্ঘদিন ভেড়ার দলে থাকলে মানুষও ভেড়ার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি কিছুদিন আগে দেখলাম, জেরেমি করবিনের একটি ছবি। তিনি ট্রেনের সিটে বসার জায়গা না পেয়ে নিচে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে যাচ্ছেন। আরে বাবা তুমি তো শ্রমিক দলের মানুষ। তোমাকে ধনবানদের এ ভড়ং ধরতে হবে কেনো? না-কি ওই ভেড়ার পালের সাথে উঠা-বসার কারণে তোমারও ভেড়ার ‘প্রক্সি’ দেয়ার সখ জেগেছে! হায়রে ধনবাদী সমাজ। চাইলেও সবাই ভাল থাকতে পারে না।
বেশ আগের কথা মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশে তখন মহামহিম খান-ই-খানান মহাকবি জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসেছেন। দেশের সংবিধান লঙ্গন করে সামরিক পোশাকের জোরে বেকায়দায় থাকা বাকী ধনবানদের গোপন সুপারিশে মসনদে আলা হয়ে আসিন হয়েছেন। দেশের কেউ তেমন চেনে না। সাধারণ মানুষ তো একেবারেই চেনে না। দেশের রাজনীতিতে কোন অবদান নেই। পাকিস্তান থেকে অন্যান্যদের মত পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধেও শরিক হননি। মানুষ চিনবে কি করে? ধনবান এরশাদের প্রতিভা বা ‘কেরিশমা’ দেখাবার ইচ্ছা জাগলো। দেশী-বিদেশী মুরব্বিরাও পরামর্শ দিলেন একটু ‘কেরিশমা’ দেখাতে। কি করবেন! কি করবেন! সমাধান পেয়েও গেলেন। স্থির করলেন। বাইসাইকেল চালিয়ে অফিসে যাবেন। হবু চন্দ্র রাজার হুকুম। তামিল করতেই হবে। সাধারণ মানুষকে একটু বোকা না বানালে লুন্ঠন হবে কি করে! যেই কথা সেই কাজ। সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। রাজা করবেন অফিস, সাইকেলে চড়ে! ওই আধঘন্টার সাইকেল চালনার পেছনে দেশের ভান্ডার থেকে কত খরচ হয়েছিল দেশের তাবৎ তাবৎ সংবাদপত্রগুলো সেদিন কোন হিসাবই দেয় নি। দিতে পারেও নি। এরশাদ ‘কেরিশমা’ দেখালেন।
নিরীহ সাধারণ মানুষ ধনবাদী রাজনীতির গভীরের এতোকিছু বুঝেনা। মানুষকে বোকা বানানোর ধনবাদী এসব ‘কেরিশমা’র সাথে সাধারণ মানুষের চেনা-জানাও নেই। বোকা হয়ে হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে সেদিন মুহুর্মূহু করতালি দিয়ে বাহবা জানিয়েছিল। এরশাদ দশ বছর মসনদে আসীন ছিলেন। তার বিরুদ্ধে তখন সংবিধান লঙ্ঘনের মামলাও হয়েছিল। আজও সেই মামলা আদালতে আছে। থাকলে কি হবে। ওই যে ধনবানদের সমাজ, আইন তো তাদেরই আখের গোঁছানোর জন্য। কিতাবে লিখা আইনতো শব্দসমষ্ঠিমাত্র। নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই।
লন্ডন,রোববার
৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৬